মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১: পরাজয়ের ঠিক আগে যা ঘটেছিল আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যে অবস্থা হয়েছিল ঢাকার ক্যান্টনমেন্টে

মুক্তিযুদ্ধ

ছবির উৎস, AFP/Getty Image

ছবির ক্যাপশান, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে মরণপণ লড়াই চলে টানা নয় মাস ধরে
    • Author, সায়েদুল ইসলাম
    • Role, বিবিসি বাংলা, ঢাকা

তেসরা ডিসেম্বর যখন ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তখন শুরুতে পাকিস্তানী কর্মকর্তাদের ধারণা ছিল তারা ভারতকে হারিয়ে দিতে পারবেন। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের সেই ধারণা ভেঙ্গে যায়।

ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই পরাজয়ের ভীতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল ঢাকায় পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তাদের ভেতর।

তখনকার ঘটনাবলী খুব কাছ থেকে দেখেছেন পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নর ডা. এম এ মালিকের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক।

রাও ফরমান আলী তার বই "হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড" এবং সিদ্দিক সালিক তার লেখা লেখা 'উইটনেস টু সারেন্ডার' বইয়ে সেই সময়কার ঘটনাবলীর বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন, জানিয়েছেন ঢাকার ক্যান্টনমেন্টে তখন পরিস্থিতি কেমন ছিল।

ডিসেম্বরের দুই তারিখে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খানের ঢাকায় আসার কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে জানানো হয় তিনি আসবেন না। সেই খবরে যুদ্ধের পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে অনেকেই পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান।

রাও ফরমান আলীর বর্ণনা অনুযায়ী, যেদিন ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়, সেই ৩রা ডিসেম্বর লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজীকে বেশ আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছিল।

''কারো মধ্যে কোন আতঙ্ক ছিল না। সবাই খুব আস্থার সঙ্গে কথা বলছিলেন। অসামরিক সরকারের কাছ থেকে তারা কিছু প্রত্যাশা করেন কি-না, জানতে চাইলে জেনারেল নিয়াজী বলেন, আমরা আমাদের দেখাশোনা করতে পারবো। আমাদের সব কিছুই আছে।''

কিন্তু খুব দ্রুতই সেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়।

ভারতীয় বিমান বাহিনীর হামলায় পাকিস্তান বাহিনীর সবগুলো বিমান অকেজো হয়ে পড়ে।

ডিসেম্বরের পাঁচ তারিখে কুমিল্লার দক্ষিণ অঞ্চলে একটি পাকিস্তানী ব্যাটালিয়নের আত্মসমর্পণের পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বুঝতে পারলেন যে তাদের সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে গেছে।

যুদ্ধের সময় যশোর রোডের সড়ক মেরামত করছেন ভারতীয় সেনারা

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান, যুদ্ধের সময় যশোর রোডের সড়ক মেরামত করছেন ভারতীয় সেনারা

জেনারেল নিয়াজী সন্দেহাতীতভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলেন। অনেকে জেনারেল নিয়াজীকে তাঁর অফিসে কাঁদতেও দেখেছে বলে দাবী করেন রাও ফরমান আলী।

কিন্তু বাইরে থেকে জেনারেল নিয়াজী নিজেকে শক্ত হিসেবে উপস্থাপন করছিলেন।

পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার জন্য ৭ই ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজীকে ডেকে পাঠান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. এম এ মালেক, জেনারেল রাও ফরমান আলী লিখেছেন "হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড" বইয়ে।

''গভর্নর বলতে শুরু করেন, যুদ্ধে যে কোনও কিছুই ঘটতে পারে। যখন দুটি পক্ষ যুদ্ধ শুরু করে, তখন একপক্ষ জেতে, অন্য পক্ষ হেরে যেতে পারে। কোনও সময় একজন কমান্ডারকে আত্মসমর্পণ করতে হতে পারে, এবং অন্য সময় .... গভর্নর আরও কিছু বলার আগে আমি একটি চিৎকার, একটি কান্না এবং উচ্চ শব্দে ফোঁপানো শুনতে পেলাম।

আমি দেখলাম, নিয়াজী তাঁর দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রয়েছেন এবং কাঁদছেন।

সেই সময় কক্ষে আসা একজন পরিচারক চা নিয়ে প্রবেশ করছিল, তাকে দ্রুত বের করে দেয়া হয়। সে বাইরে গিয়ে বলেন, সাহেবরা ভেতরে কান্নাকাটি করছেন।

এই খবরটি দ্রুত ঢাকার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। যা থেকে পাকিস্তান আর্মির ভয়াবহ ও মরিয়া অবস্থার কথাই প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল।''

আরো পড়তে পারেন:

যুদ্ধের সমাপ্তি - ঢাকার রেসকোর্সে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ
ছবির ক্যাপশান, যুদ্ধের সমাপ্তি - ঢাকার রেসকোর্সে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ

তখনও সেনা কর্মকর্তারা আশায় ছিলেন যে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সাহায্য পাওয়া যাবে।

সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, জেনারেল নিয়াজীর মনোবল ঠিক রাখার জন্য রাওয়ালপিন্ডি এক অভিনব পন্থা উদ্ভাবন করে। (সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ড থেকে) তারা তাকে জানায় যে চীন ও আমেরিকা থেকে সাহায্য আসছে।

এ প্রসঙ্গে লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজী তার 'দ্যা বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান' বইতে লিখেছেন, ''১২ই ডিসেম্বর চীফ অব জেনারেল স্টাফ গুল হাসান আমাকে টেলিফোন করে পশতু ভাষায় বলেন, 'উত্তর দিক থেকে পীত আর দক্ষিণ দিক থেকে শ্বেতাঙ্গরা এগিয়ে আসছে (সম্ভাব্য চীন ও মার্কিন সহায়তাকে বুঝাতে তিনি প্রতীকী ভাষা ব্যবহার করেন)। সিজিএস আমাকে কেন ধোঁকা দিলেন, আমি তা বুঝতে পারিনি।''

তবে সেই সময়ে তিনি অবশ্য এটিকে ধোঁকা বলে বুঝতে পারেননি।

নিয়াজী এই খবর শোনার পর সেটি সব সৈন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে বলেন। এর ফলে কিছু বিভ্রান্তিও তৈরি হয়। টাঙ্গাইলে ভারতীয় প্যারাট্রুপারদের নামতে দেখে পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি দল তাদের স্বাগত জানাতে গিয়ে ভারতীয়দের হাতে বন্দী হয়।

জেনারেল এ এ কে নিয়াজীকে প্রথমে ধারণা দেয়া হয়েছিল যে ১২ই ডিসেম্বরের মধ্যে এই সাহায্য পাওয়া যাবে। ঢাকায় চীন বা আমেরিকার কনস্যুলেট এই তথ্যের ব্যাপারে কিছুই নিশ্চিত না করলেও ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের তখন সবাই চীনা সাহায্যের জন্য উত্তর দিকে, আর আমেরিকার নৌ সাহায্যের আশায় দক্ষিণ দিকে তাকিয়ে ছিল।

১৯৭১ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত মাধবপুর এলাকা

ছবির উৎস, STR/AFP via Getty Images

ছবির ক্যাপশান, ১৯৭১ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি এলাকা

সেই সময় ক্যান্টনমেন্টে এই সম্ভাব্য বিদেশি সাহায্যের বর্ণনা দিয়ে সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, 'ঢাকায় কৌশলগত ইউনিটের সদর দপ্তরে একজন ব্যাটম্যানকে দুই ব্যান্ডের একটি ট্রানজিস্টার ঠিক করতে দেখছিলাম। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সে স্যালুট দিলো।

'কোন খবর আছে?' আমি জানতে চাইলাম। সে ঠাণ্ডা কণ্ঠে জবাব দিলো, 'চীনা বা আমেরিকার সাহায্যের কোন খবর নেই।'''

লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসান 'মেমোরিজ অব গুল হাসান' বইয়ে দাবি করেছেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন চীফ অব স্টাফ জেনারেল হামিদের নির্দেশক্রমে তিনি ওই বার্তা পাঠিয়েছিলেন।

যুদ্ধের সময় ঢাকায় অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের লেখা থেকে বোঝা যায় যে, সাহায্য আসার সম্ভাবনা দেখতে না পেয়ে ১২ই ডিসেম্বর পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তারা যুদ্ধের বিষয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাদের লেখা বই থেকে এটা বোঝা যায় যে পাকিস্তানী বাহিনীর মনোবল একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছিল।

কিভাবে যুদ্ধ থামানো যায়, সে চেষ্টা করছিলেন ঢাকায় অবস্থানরত পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তারা।

ওই কর্মকর্তারা চেষ্টা করছিলেন, দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে সৈন্য সরিয়ে নিয়ে এসে ঢাকা রক্ষা করতে।

''কাগজে কলমে ঢাকা প্রতিরক্ষার অনেক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল," লিখেছেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক তার 'উইটনেস টু সারেন্ডার' বইয়ে।

"কিন্তু ভূমিতে পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। সৈন্যদের নৈতিক মনোবল ছিল না, অস্ত্রশস্ত্র ছিল সেকেলে ধরণের, নির্ভুল নয় বা অকার্যকর। সব চেয়ে খারাপ ছিল যে তাদের যুদ্ধ করার কোন ইচ্ছাই ছিল না। তারা বোবার মতো তাদের জায়গায় দাঁড়িয়েছিল এবং ছোট্ট একটা চাপেই ভেঙ্গে পড়ার জন্য প্রস্তুত ছিল।''

সেই সময় ঢাকার পরিস্থিতি নিয়ে বর্ণনায় "হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড" বইয়ে রাও ফরমান আলী লিখেছেন, ''ঢাকাকে রক্ষা করার জন্য তখন কোনও নিয়মিত ট্রুপস পাওয়া যাচ্ছিল না। কোর এইচ কিউ ঢাকার প্রতিরক্ষার জন্য কিছু ট্রুপস পাঠানোর জন্য অধীনস্থ ফর্মেশনগুলোকে বলেছিল। কিন্তু পরিবহনের অভাবে ট্রুপস সংগ্রহ করা যায়নি।''

তিনি আরও লিখেছেন, ঢাকা একটি ভূতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছিল এবং মুক্তিবাহিনীর তৎপরতার ভয়ের কারণে বেশিরভাগ সময় ঢাকা থাকত কারফিউর অধীনে।

''ঢাকায় জীবন একেবারে থেমে গিয়েছিল। নগরীর ভেতরে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা মোকাবিলার উদ্দেশ্যে কারফিউ লাগানো হয়েছিল। সকল সড়কেই সড়ক প্রতিবন্ধক নির্মাণ করা হয়েছিল, তারপরেও গেরিলাদের অনুপ্রবেশ অব্যাহত ছিল।''

পরাজয় আসন্ন বুঝতে পেরে পাকিস্তান সমর্থক বেসামরিক কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আতংক ছড়িয়ে পড়েছিল সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যেও।

''সিভিলিয়ান অফিসিয়ালরা তো বটেই, এমনকি আর্মি অফিসারদের অনেকে ভীত হয়ে পড়েছিলেন। মুক্তিবাহিনী গণহত্যা করবে বলে তারা আশংকা করছিলেন," লিখেছেন রাও ফরমান আলী।

"অনেক অফিসার ও সৈনিক আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, আপনারা কেন আমাদের মাংসের কীমা বানাচ্ছেন? দয়া করে কিছু করুন। যারা কোনও অপরাধ করেছিল, বিশেষ করে তারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল।''

আর সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, ''দুইজন অফিসার কাঁধে প্রচুর পরিমাণ তকমা ঝুলিয়ে আমার কাছে এলেন এবং বললেন, জেনারেল নিয়াজীর কাছে যাতায়াত আছে তোমার। কেন তাকে বাস্তববাদী হতে বলছো না? নইলে কুকুরের মতো মৃত্যু ঘটবে আমাদের।''

ভিডিওর ক্যাপশান, বিবিসি বাংলা থেকে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে প্রচারিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার খবর।

ভারতীয় বিমান বাহিনীর আক্রমণে ৮ই ডিসেম্বরের মধ্যেই পাকিস্তানীদের বিমান শক্তি অচল হয়ে যায়। বিমানবন্দরে বোমার আঘাতে রানওয়েতে বড় বড় গর্তের তৈরি হয়। রানওয়ে মেরামত করতে ব্যর্থ হয়ে অবশিষ্ট বৈমানিকদের রেঙ্গুন হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।

তবে ভারতীয় আক্রমণের ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর বা তার কর্মকর্তারা আগে কোন আভাস পাননি বলে দাবি করেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী।

তিনি জানান, ৩রা ডিসেম্বর যখন ভারতীয় আক্রমণ শুরু হয়, তখন তিনি বিবিসির দুইজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। যখন তিনি তাদের বলছিলেন যে, ভারতের সঙ্গে কোন যুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা নেই, তখনই তাকে সেনা সদর থেকে টেলিফোন করে জানানো হয় যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। গভর্নরও এটি জানতেন না।

এমনকি পাকিস্তানের নৌ বাহিনীর প্রধান এবং আইএসআই প্রধানও এ বিষয়ে আগে জানতেন না বলে উল্লেখ করেন রাও ফরমান আলী।

ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে পড়লেও জেনারেল নিয়াজী তখনও আশাব্যঞ্জক নানা রিপোর্ট পাঠাচ্ছিলেন সদর দপ্তরে।

সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসান 'মেমোরিজ অব গুল হাসান' বইয়ে লিখেছেন, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড থেকে পাওয়া রিপোর্টগুলো এই ধারণাই তৈরি করলো যে শত্রুর হামলাকে ভোঁতা করে দেয়া হয়েছে।

"সিওএস অফিস জুড়ে প্রবল আশাবাদ - একবার আমাকে বলেই ফেললেন, বল এখন নিয়াজীর পায়ে। কিন্তু নিয়াজীর পায়ে বল বেশিদিন থাকেনি। পশ্চিমে আমাদের বিমান হামলার জবাবে ৩রা ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তুমুল লড়াই বেধে যাওয়া মাত্রই বল চলে যায় তার পা থেকে। ....ওগুলো আঁকড়ে থাকার অর্থ পরাজয়কে ডেকে আনা হলেও নিয়াজী আশাব্যঞ্জক রিপোর্ট পাঠিয়ে যাচ্ছিলেন। আমার অনুমান, প্রেসিডেন্ট ও তার মুরুব্বি সিওএসকে খুশি রাখার উদ্দেশ্যে।''

তিনি আরও লেখেন, নিয়াজীর রঙচঙ দেয়া রিপোর্টের ওপর আস্থা স্থাপনে যারা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, তারা এক প্রবল ঝাঁকুনি খান ৯ই ডিসেম্বরে।

"পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড প্রকৃত অবস্থা জানিয়ে রিপোর্ট করে। তার মূলকথা ছিল, শত্রুর তৎপরতা আর বিদ্রোহীদের হামলার ফলে ঢাকা রক্ষার জন্য সৈন্যদের সরিয়ে আনা যাচ্ছে না। শত্রুর বিমান ব্যাপক ধ্বংসসাধন করেছে।''

সেই সময় পরিস্থিতি বুঝে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গভর্নরকে ক্ষমতা দেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। তিনি যুদ্ধবিরতির একটি প্রস্তাব পাঠান জাতিসংঘে। তবে সেই প্রস্তাবের কথা পরে রাওয়ালপিন্ডি থেকে অস্বীকার করা হয়।

১২ই ডিসেম্বরে পরিষ্কার হয়ে যায় যে চীন বা আমেরিকা থেকে কোন সাহায্য আসছে না। সেই সময় নিয়াজী একেবারেই হতাশ হয়ে পড়েন। তিনি কয়েকদিন ধরে কারো সঙ্গেই কথাবার্তা বলছিলেন না।

রাও ফরমান আলী লিখেছেন, ১২ই ডিসেম্বর ঢাকায় প্রথমবারের মতো মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীর কামানের শব্দ শোনা যাচ্ছিল।

তিনি জানান, ১৩ই ডিসেম্বর তার বাসায় ছোট একটি মিটিং হয় মেজর জেনারেল রহিম, নিয়াজী এবং জামশেদের মধ্যে। সেখানে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটানোর ব্যাপারে তিনজনই একমত হয়ে রাওয়ালপিন্ডিকে তা জানানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন বলে তার মনে হয়েছে।

ওই দিনই গভর্নর হাউজে ভারতীয় বিমানবাহিনী গোলাবর্ষণ করার পর গভর্নরের পদ থেকে পদত্যাগ করেন এ এম মালিক এবং তিনি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় নেন।

যুদ্ধবিরতির প্রত্যাশা নিয়ে ১৪ই ডিসেম্বর বিকেলে জেনারেল নিয়াজী ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জেনারেলের কাছে যান। সাথে ছিলেন রাও ফরমান আলী।

ভারতীয় ছত্রীসেনাদের যে অনুশীলনের ছবি ভারতীয় সেনারা টাঙ্গাইলে প্যারাড্রপিং-এর ছবি হিসাবে সংবাদমাধ্যমে প্রচারের জন্য ব্যবহার করেছিল

ছবির উৎস, INDIAN ARMY, EASTERN COMMAND

ছবির ক্যাপশান, ভারতীয় ছত্রীসেনাদের যে অনুশীলনের ছবি ভারতীয় সেনারা টাঙ্গাইলে প্যারাড্রপিং-এর ছবি হিসাবে সংবাদমাধ্যমে প্রচারের জন্য ব্যবহার করেছিল

তখন জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে মার্কিন কনসাল জেনারেলের যে কথা-বার্তা হয়েছিল, সেটি রাও ফরমান আলী তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন।

"নিয়াজী একজন বন্ধু হিসেবে তার সাহায্য চাইলেন। জবাবে কনসাল জেনারেল বললেন, আপনারা কেন যুদ্ধ শুরু করেছিলেন? ইউএস আপনাদের সাহায্য করতে পারবে না। আমি বড়জোর যা করতে পারি তা হলো, আপনার বার্তাটি ভারতীয়দের কাছে পৌঁছে দিতে পারি।

আমি বার্তা প্রেরকের কাজ করবো, যোগাযোগকারী নয়। আমাদের বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে এবং যেখানে যার কাছে বার্তা পাঠাতে চান, আপনি পাঠাতে পারেন।"

যুদ্ধবিরতির জন্য ভারতীয়দের কাছে যে বার্তা পাঠানো হয়েছিল, তার জবাব এসেছিল ১৫ই ডিসেম্বর। ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ সেটির উত্তর দিয়েছিলেন।

ওই বার্তায় জেনারেল মানেকশ বলেছিলেন, যুদ্ধবিরতি তখনই কার্যকর হবে যখন পাকিস্তানী বাহিনী অগ্রবর্তী ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে।

ভারতীয় সেনাপ্রধানের এই বার্তা রাওয়ালপিন্ডিতে পাঠিয়ে দেয়া হলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান ঢাকায় জানিয়ে দেন জেনারেল মানেকশ'র প্রস্তাব মেনে নিতে।

ভিডিওর ক্যাপশান, বাংলাদেশে গণহত্যার ইতিহাস তুলে ধরতে খুলনায় গণহত্যা জাদুঘর।