ভারতের মুম্বাইতেই কেন বার বার আঘাত হেনেছে দাঙ্গা-হাঙ্গামা আর সহিংসতার তান্ডব ?

২৬/১১র রাতে দাউ দাউ করে জ্বলছে মুম্বাইয়ের আইকনিক তাজ হোটেল

ছবির উৎস, PAL PILLAI

ছবির ক্যাপশান, ২৬/১১র রাতে দাউ দাউ করে জ্বলছে মুম্বাইয়ের আইকনিক তাজ হোটেল
    • Author, শুভজ্যোতি ঘোষ
    • Role, বিবিসি বাংলা, দিল্লি

২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর রাতে ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইতে এক নজিরবিহীন জঙ্গী হামলায় নিহত হয়েছিলেন অন্তত ১৬৪জন দেশী-বিদেশি নাগরিক - যে ঘটনার দশ বছর পূর্ণ হচ্ছে।

কিন্তু মুম্বাইয়ের ইতিহাসে এর চেয়েও বড় বড় সহিংসতার অনেক নজির আছে - চুরাশি বা বিরানব্বইয়ের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ওই শহরেই হাজার হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছেন, ৯৩ বা ২০০৩য়ে সিরিজ বোমা বিস্ফোরণেও মৃত্যুর সংখ্যা ছিল শত শত।

কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ একটি শহরে কেন বারবার এভাবে সহিংসতা আঘাত হেনেছে?

কোথায় এর উৎস, আর কীভাবেই বা এত বড় বড় ধাক্কা সামলে উঠেছে ভারতের এই 'ম্যাক্মিমাম সিটি'?

মুম্বাইয়ের শহরতলির ট্রেনে সিরিজ বোমা বিস্ফোরণ। জুলাই, ২০০৬

ছবির উৎস, Hindustan Times

ছবির ক্যাপশান, মুম্বাইয়ের শহরতলির ট্রেনে সিরিজ বোমা বিস্ফোরণ। জুলাই, ২০০৬

সরেজমিনে তারই খোঁজখবর নিতে পাড়ি দিয়েছিলাম আরব সাগরের তীরে এই বর্ণিল শহরে।

২০০৮র ২৬ নভেম্বর গ্লোবাল টেরর ম্যাপ বা বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের মানচিত্রে মুম্বাইকে নতুন করে চিনিয়েছিল ঠিকই - কিন্তু এই শহরে বড় বড় দাঙ্গা-সহিংসতার ইতিহাস আসলে অনেক পুরনো।

মুম্বাইয়ের কবি-সাংবাদিক-ফিল্ম নির্মাতা প্রীতীশ নন্দী কিন্তু বিশ্বাস করেন, এত দাঙ্গা-হাঙ্গামার পরেও শহরটার ডিএনএ কিন্তু কখনওই বদলায়নি।

তার কথায়, "আমার ধারণা বোম্বের মতো শহরে যতটা ভায়োলেন্স হতে পারত ততটা কিন্তু হয়নি। এটা অনেকেটা নিউ ইয়র্কের মতো ... নিউ ইয়র্কেও বম্বিং হয়েছে, টেররিস্ট অ্যাটাক হয়েছে। কিন্তু তাতে কি নিউ ইয়র্কের কালচার বদলে গেছে? একেবারেই না।"

মুম্বাইয়ের কবি-সাংবাদিক-লেখক ও ফিল্ম নির্মাতা প্রীতীশ নন্দী

ছবির উৎস, Rubina A. Khan

ছবির ক্যাপশান, মুম্বাইয়ের কবি-সাংবাদিক-লেখক ও ফিল্ম নির্মাতা প্রীতীশ নন্দী

"বোম্বেরও তাই। এখানে যা ঘটেছে, সেগুলো অ্যাবারেশন বা অ্যাকসিডেন্ট বলাই ভাল। কিন্তু বোম্বের সাঙ্ঘাতিক লিবারেল কালচারটায় তা কোনও প্রভাবই ফেলতে পারেনি!"

কিন্তু যে শহরে মেয়েরা মধ্যরাতের পরও মেরিন ড্রাইভে নিশ্চিন্তে হাঁটাহাঁটি করতে পারেন, কিংবা ভোররাতেও নির্ভাবনায় চলাফেরা করতে পারেন শহরতলির লোকাল ট্রেনে - সেখানেই কেন বারবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা বোমা বিস্ফোরণ আঘাত হানে?

মহারাষ্ট্র পুলিশের মহাপরিচালক হয়ে অবসর নিয়েছেন মীরন বোরওয়ানকার - যার কর্মজীবনের বেশিটাই কেটেছে মুম্বাইতে।

সাবেক এই ডাকসাইটে পুলিশকর্তা বলছেন, "মুম্বাই একটা 'জিও আউর জিনে দো', অর্থাৎ চুটিয়ে বাঁচো আর বাঁচতে দাও মার্কা সংস্কৃতিকে বিশ্বাস করে ঠিকই - কিন্তু এই শহরেই এমন দুটো এলিমেন্ট রয়েছে, যারা সব সময় অশান্তির বাহানা খোঁজে।"

মুম্বাই পুলিশের সাবেক যুগ্ম কমিশনার মীরন বোরওয়ানকর

ছবির উৎস, Hindustan Times

ছবির ক্যাপশান, মুম্বাই পুলিশের সাবেক যুগ্ম কমিশনার মীরন বোরওয়ানকর

"তার একটা হল স্বার্থপর কিছু রাজনীতিবিদ - আর অন্যটা সমাজবিরোধী চক্র।"

"ফলে যখনই বাবরি মসজিদ ভাঙা কিংবা মারাঠা নায়ক শিবাজী মহারাজকে নিয়ে কোনও বিতর্কিত গবেষণার মতো কোনও ট্রিগার থাকে - এরা সেগুলোকে উসকে দিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাঁধাতে এক মুহুর্তও দ্বিধা করে না!"

কিন্তু কেন ব্যাঙ্গালোর-কলকাতা-চেন্নাই নয়, বরং মুম্বাই-ই বারবার এই ধরনের হামলার নিশানায় ?

শহরের কর্পোরেট দুনিয়ার হঞ্চো অনুপম ভট্টাচার্য বলছেন, আসলে মুম্বাইতে হামলা চালিয়ে যে ধরনের ইমপ্যাক্ট বা অভিঘাত পাওয়া যাবে, এমন কী দিল্লিতেও সেটা সম্ভব নয়।

মুম্বাইয়ের বাস নেটওয়ার্কের ওপর সিরিজ বোমা হামলা। ২০০৩

ছবির উৎস, SEBASTIAN D'SOUZA

ছবির ক্যাপশান, মুম্বাইয়ের বাস নেটওয়ার্কের ওপর সিরিজ বোমা হামলা। ২০০৩

তিনি বলছিলেন, "তিরানব্বই থেকে শুরু করে দুহাজার আট - মুম্বাইকে যে বারবার টার্গেট করা হয়েছে তার মূল কারণ হল ভিজিবিলিটি বা অ্যাটেনশন।"

"একটা বোমা দিয়ে ... সাতটা ট্রেনে সাতটা বোমা পেতে রেখে প্রতিটায় অন্তত একশো মানুষকে মারা সম্ভব! এই ধরনের অ্যাটেনশন তো দিল্লিতেও মিলবে না!"

দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাঙ্কার থেকে রাজনীতিবিদ হওয়া মীরা সান্যালও অনেকটা একই মতামতের শরিক।

"একজন জঙ্গীর দৃষ্টিভঙ্গীতে যদি দেখি, তাহলে মুম্বাইকে স্তব্ধ করে দিতে পারলে আপনি কিন্তু অনেক বেশি ক্ষতি সাধন করতে পারবেন।"

মীরা সান্যাল

ছবির উৎস, Hindustan Times

ছবির ক্যাপশান, মীরা সান্যাল

"তবে এই শহরটাই চরিত্রেই এমন একটা প্র্যাগম্যাটিজম বা বাস্তববাদ আছে যে বড় বড় বিপর্যয় থেকেও গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে সেটা এক মুহুর্তও সময় নেয় না।"

"২৬/১১-র হামলার সময় আমি যে রয়্যাল ব্যাঙ্ক অব স্কটল্যান্ডের দায়িত্বে ছিলাম - পরদিন কিন্তু তার একটা ছাড়া শহরের সবগুলো ব্রাঞ্চ চালু ছিল।"

"ভয়ঙ্করতম বিপদেও এই শহরটা এককাট্টা হয়ে নিজের সেরাটা উজাড় করে দিতে পারে।"

দশ বছর আগে মুম্বাইয়ের গেটওয়ে অব ইন্ডিয়ার কাছে জঙ্গীরা যে হোটেল তাজে হামলা চালিয়েছিল, তার সামনেই ট্যুরিস্ট গাইডের কাজ করেন নীলেশ প্রভাকর, সাব্বির আহমেদরা।

২৬/১১র হামলার পর মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজী রেল টার্মিনাস

ছবির উৎস, STR

ছবির ক্যাপশান, ২৬/১১র হামলার পর মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজী রেল টার্মিনাস

নীলেশ বলছিলেন, "২০০৩য়ে মুম্বাইতে যে সিরিজ বোমা হামলা হয়েছিল আর ২০০৮-র জঙ্গী হামলার মধ্যে কিন্তু অনেক ফারাক।"

"২০০৩য়ে মানুষের মধ্যে অত হেলদোল ছিল না, কিন্তু এখন মুম্বাই অনেক সাবধান হয়ে গেছে।"

সাব্বির আহমেদ পাশ থেকে যোগ করেন, "আমরা এখন প্রতিটা নতুন মানুষের ওপর সতর্ক নজর রাখি। তাদের সব রকম সাহায্য করি ঠিকই, কিন্তু শহরের নিরাপত্তার সঙ্গে কোনও আপস করে নয়!"

তবে যদি ধরেও নিই, ২৬/১১-র হামলা পুরোপুরি বিদেশি শক্তির কাজ, তার আগেও মুম্বাই যে সব ভয়ঙ্কর সহিংসতার সাক্ষী থেকেছে - সেগুলোর উৎস কোথায়?

সাংবাদিক হরিশ নাম্বিয়ার

ছবির উৎস, বিবিসি বাংলা

ছবির ক্যাপশান, সাংবাদিক হরিশ নাম্বিয়ার

মুম্বাইয়ের প্রবীণ সাংবাদিক হরিশ নাম্বিয়ার বলছেন, "হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা কিন্তু এ শহরে অনিবার্য ছিল। আশির দশকে বিজেপির উত্থানেরও অনেক আগে এখানে শিবসেনার জন্ম - যারা একটি আঞ্চলিকতাবাদী দল, স্থানীয়দের ভাষা-সংস্কৃতির আবেগকে উসকে দিয়েই তাদের আবির্ভাব।"

"নিজেদের শক্তিবৃদ্ধির জন্য তাদের এই মুম্বাই শহরের স্পেসের ভেতরেই একটা 'শত্রু' দরকার ছিল।"

"প্রথমে তারা বেছে নিয়েছিল দক্ষিণ ভারতীয়দের - সরকারি চাকরিতে মুম্বাইতে যত দক্ষিণ ভারতীয় ছিলেন, টেলিফোন ডিরেক্টরি থেকে তাদের নামের তালিকা হুবুহু তুলে দিয়ে বাল ঠাকরে ছেপে দিতেন নিজের ম্যাগাজিনে।"

এর পরই শুরু হয়েছিল দক্ষিণ ভারতীয়দের কলোনি বা রেস্তোরাঁগুলোয় হামলা।

মুম্বাইয়ের খার এলাকায় ভয়াবহ দাঙ্গার পর ধ্বংসস্তূপের সামনে এক মুসলিম দোকানদার। জানুয়ারি, ১৯৯৩

ছবির উৎস, DOUG CURRAN

ছবির ক্যাপশান, মুম্বাইয়ের খার এলাকায় ভয়াবহ দাঙ্গার পর ধ্বংসস্তূপের সামনে এক মুসলিম দোকানদার। জানুয়ারি, ১৯৯৩

ভিনরাজ্যের 'শত্রু'দের এভাবে ঠান্ডা করার পর শিবসেনার নজর পরে ভিনধর্মের শত্রুদের ওপর - আর সেখানেই নিহিত ছিল মুম্বাইয়ে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার বীজ।

অনুপম ভট্টাচার্যও বলছিলেন, বাবরি ভাঙা বা গুজরাট রায়টের পর মুম্বাইতে যে সব বিস্ফোরণ বা হামলা হয়েছে তার সব ক্ষেত্রেই কিন্তু নিশানায় ছিলেন খুব সুনির্দিষ্ট লোকজন।

"৯৩-র হামলায় নিশানা ছিলেন ধনী ব্যবসায়ী শ্রেণী - যারা বাবরি ভাঙাকে সমর্থন করছিলেন।"

"সেই জন্যই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল স্টক এক্সচেঞ্জ বা এয়ার ইন্ডিয়া বিল্ডিংয়ে, যেগুলো ছিল সে আমলের ধনীদের প্রতীক।"

"একই ভাবে যে সিরিজ ট্রেন হামলা হয়, সেটা ছিল গোধরা কান্ডের পর - আর টার্গেট ছিলেন গুজরাটি ব্যবসায়ীরা।"

"এরা সন্ধ্যাবেলার লোকাল ট্রেনে ফার্স্ট ক্লাসে ট্র্যাভেল করেন, আর সবগুলো ব্লাস্টই হয়েছিল ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্টে। এগুলো নিয়ে হয়তো কোনও সরকারি তদন্ত রিপোর্ট নেই, কিন্তু ঘটনাগুলো মিলিয়ে দেখলে নকশাটা বুঝতে অসুবিধা হয় না!"

বাবরি-পরবর্তী দাঙ্গা যে মুম্বাইয়ের মতো শহরেও তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়েছিল তা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই প্রীতীশ নন্দীরও।

"হ্যাঁ, সেইবার কিন্তু ইমপ্যাক্ট হয়েছিল - কারণ মানুষ ভীষণ ভয় পেয়েছিল। তারা জানত না কীভাবে সেই বিপদে বন্ধু-বান্ধব পরিবারকে রক্ষা করতে হবে। হিন্দুরা তখন ভাঙচুর-লুঠপাটে নেমে পড়ল। একই জিনিস করল মুসলিমরাও।"

'৯৩র দাঙ্গার সময় অভিযুক্ত সঞ্জয় দত্ত বেরিয়ে আসছেন টাডা কোর্ট থেকে (ফাইল চিত্র)

ছবির উৎস, Hindustan Times

ছবির ক্যাপশান, '৯৩র দাঙ্গার সময় অভিযুক্ত সঞ্জয় দত্ত বেরিয়ে আসছেন টাডা কোর্ট থেকে (ফাইল চিত্র)

"সঞ্জয় দত্তের মতো অভিনেতা অস্ত্র নিয়ে ধরা পড়লেন। বোকার মতো কাজ করেছিলেন, কিন্তু কথা হল তারও ভয় ছিল যে বিরাট গন্ডগোল বাঁধতে চলেছে।"

"কিন্তু যে শহরে লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র ব্যবসা, রোজগারের ধান্দায় কোটি কোটি মানুষ সেই শহরে আসলে খুব বড় কার্নেজ হওয়াটাও সম্ভব নয়।"

মুম্বাইয়ের এই যে খেটে-খাওয়া, রুটি-রুজির ধান্দায় অবিরত ঘোরা মানুষজন - তারাই আসলে যে কোনও বিপর্যয়ের পরও শহরের চাকাটা বারবার চালু রেখে দেন।

ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী মুম্বাইয়ের মণি ভবনে জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন, এখন সেখানেই তার নামাঙ্কিত ট্রাস্ট ও সংগ্রহশালা।

মুম্বাইয়ে থাকলে এই মণি ভবনেই থাকতেন মোহনদাস গান্ধী

ছবির উৎস, বিবিসি বাংলা

ছবির ক্যাপশান, মুম্বাইয়ে থাকলে এই মণি ভবনেই থাকতেন মোহনদাস গান্ধী

ওই সোসাইটির সচিব, আজীবন গান্ধীবাদী মেঘশ্যাম আজগাঁওকর বলছিলেন এই বৈশিষ্ট্যটাই ভারতের বাকি সব শহরের চেয়ে মুম্বাইকে আলাদা করে রেখেছে।

তার কথায়, "মুম্বাইকে নিয়ে অনেক ভুল ধারণা আছে বাইরের মানুষের - কিন্তু এই শহরে আমার জন্ম-কর্মের সুবাদে বলতে পারি এত শান্তির শহর, অহিংসার শহর দেশে আর একটিও নেই।"

"হ্যাঁ, হিংসা হয়তো আঘাত হেনেছে - কিন্তু পরক্ষণেই মুম্বাই আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মাত্র কয়েকমাস আগেও যে মুম্বাইতে পা রেখেছে সেও জানে এ শহর তারই - আর সেই ধারণাতে কোনও ভুলও নেই।"

তাহলে মুম্বাইয়ের অন্ধকার মাফিয়া জগত বা আন্ডারওয়ার্ল্ডের রমরমা নিয়ে যে এত কথা শোনা যায়, শহরের বড় বড় সহিংসতার পেছনে তাদেরও কি কোনও ভূমিকা নেই?

মুম্বাইতে গান্ধী সোসাইটির সচিব মেঘশ্যাম আজগাঁওকর

ছবির উৎস, বিবিসি বাংলা

ছবির ক্যাপশান, মুম্বাইতে গান্ধী সোসাইটির সচিব মেঘশ্যাম আজগাঁওকর

প্রীতিশ নন্দীর কথায়, "আমি বলব এটা হচ্ছে শহরের একটা মিথিক আন্ডারবেলি।"

"দায়ুদ ইব্রাহিম আসার অনেক আগে থেকেই এ শহরের আন্ডারওয়ার্ল্ডে হাজি মস্তান, করিম লালা, আলংজেব-দের দাপট ছিল - তাদের মধ্যে মারামারি, স্ট্রীট ফাইটিং, খুনোখুনি সবই হত।"

"কিন্তু গ্যাংলর্ডসদের এই দ্বন্দ্বে শহরের ওপর কখনও কোনও প্রভাব পড়েনি, কোনও দিন না!"

এভাবেই আসলে একটা মুম্বাইয়ের মধ্যে অনেকগুলো মুম্বাই নিরন্তর বাস করে গেছে।

দায়ুদ ইব্রাহিম। শারজা স্টেডিয়াম, ১৯৯১

ছবির উৎস, The India Today Group

ছবির ক্যাপশান, দায়ুদ ইব্রাহিম। শারজা স্টেডিয়াম, ১৯৯১

একটা মুম্বাই যখন দাঙ্গায় বেঁকে গেছে, অন্য আর একটা মুম্বাই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছে।

সাবেক পুলিশপ্রধান মীরন বোরওয়ানকার বলছিলেন, "মাহিমে দাঙ্গা ঠেকাতে গিয়ে দেখেছি দশ মিনিটের মধ্যে লোকজন এসে জিজ্ঞেস করছে, এখন রাস্তা পেরোতে পারি, ম্যাডাম?"

"সব ঠিক তো? স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার জন্য এতটাই মরিয়া তারা - যে জিনিস আর কোথাও দেখা যায় না।"

২৬/১১-সহ শহরে অনেক বড় বড় হামলার ঘটনা কভার করেছেন মুম্বাই প্রেস ক্লাবের বর্তমান সচিব লতা মিশ্রা।

মুম্বাইয়ের আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ে বলিউডেও তৈরি হয়েছে অসংখ্য ছবি

ছবির উৎস, বালাজি ফিল্মস

ছবির ক্যাপশান, মুম্বাইয়ের আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ে বলিউডেও তৈরি হয়েছে অসংখ্য ছবি

তিনিও বলছিলেন, "মনে আছে সে রাতেই হাজার হাজার লোক হাসপাতালগুলোতে ভিড় করেছিলেন রক্ত দেওয়ার জন্য। পারেলের কে এম হাসপাতালে অনেক ভিক্টিম ভর্তি ছিলেন, আর গভীর রাতেও বাইরে ছিল রক্তদাতাদের লম্বা লাইন - তারা কেউ রক্ত না-দিয়ে যাবেনই না!"

মুম্বাই শহরের সাবেকি ইরানি ক্যাফেগুলোতে এখনও বাজে পুরনো দিনের গান, "অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল, জিনা ইঁয়াহা ... জারা হঠকে, জারা বাঁচকে ইয়ে হ্যায় বোম্বে মেরি জান ..."

বোম্বের নাম বদলে গেছে মুম্বাইতে, কিন্তু ষাট বছরেরও বেশি পুরনো এই গানটাই যেন আজও ধরে রেখেছে শহরের অদম্য প্রাণশক্তি!

অনুপম ভট্টাচার্যের কথায়, "বারবার দেখেছি শহরটা কীভাবে যেন বাউন্স ব্যাক করে স্বাভাবিকতায় ফিরে আসে।"

মুম্বাই প্রেস ক্লাবের সচিব লতা মিশ্রা

ছবির উৎস, বিবিসি বাংলা

ছবির ক্যাপশান, মুম্বাই প্রেস ক্লাবের সচিব লতা মিশ্রা

"আমার নিজের অভিজ্ঞতা আছে, ট্রেন ব্লাস্টের সময় চার্চগেটের একটা অফিসে কাজ করতাম। ব্লাস্টের পরদিনই খুব জরুরি মিটিং ছিল, সেই ট্রেন ধরেই কিন্তু যথারীতি অফিসে গেলাম, মিটিংও করলাম।"

"২৬/১১-র সময়ও দেখেছি সরকারের নির্দেশে মাত্র দু-একদিন বোধহয় স্কুল কলেজ বন্ধ রাখতে হয়েছিল - কিন্তু প্রথম সুযোগেই খুলে গিয়েছিল অফিসকাছারি।"

এটাকেই আসলে অনেকে বর্ণনা করেন বিখ্যাত 'মুম্বাই স্পিরিট' বলে। তবে বড় বড় দাঙ্গা-হাঙ্গামা-সহিংসতার পরও ঠিক কোন রসায়নে মুম্বাই বারবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে - সেটা বোধহয় একটা রহস্যই।

কিন্তু এই অনন্য বৈশিষ্ট্যই মুম্বাইকে চিরকাল আলাদা করে রেখেছে, চরম বিপর্যয়েও বারবার জুগিয়ে এসেছে অক্সিজেন।

হাজারো বিপদ সামলেও তাই আজও চুটিয়ে বাঁচছে এই শহর!