হাসনাত আব্দুল্লাহর 'সেভেন সিস্টার্স আলাদা করার হুমকি' নিয়ে বিতর্ক, ভারতে প্রতিক্রিয়া

ছবির উৎস, Getty Images
বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির একজন নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ ঢাকার এক সমাবেশে ভারতের সেভেন সিস্টার্স হিসেবে পরিচিত পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যকে 'ভারত থেকে আলাদা' করার বিষয়ে যে হুমকি দিয়েছেন তা নিয়ে দু দেশেই প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
প্রশ্ন উঠছে, এ ধরনের মন্তব্য কি মি. আব্দুল্লাহর ব্যক্তিগত, নাকি তার দল এনসিপির মতামতই তার কণ্ঠে প্রতিফলিত হয়েছে।
মি. আব্দুল্লাহ যখন ওই মন্তব্য করেন তখন মঞ্চে জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দলের নেতারা ছিলেন।
এনসিপি অবশ্য বলছে, "হাসনাত আব্দুল্লাহ ভারতের সেভেন সিস্টার্স নিয়ে শর্তযুক্ত যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটি তার নিজস্ব উপলব্ধি, দলীয় অবস্থান নয়"।
তবে মি. আব্দুল্লাহর বক্তব্যে কড়া প্রতিক্রিয়া এসেছে আসামির মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার কাছ থেকে।
ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী মি. শর্মা বলেছেন, "বাংলাদেশের নেতারা যদি ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে দেশটির উত্তরপূর্বাঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করার হুমকি দেওয়া অব্যাহত রাখেন তাহলে নয়া দিল্লি বেশিদিন চুপ থাকবে না"।
ওদিকে মি. আব্দুল্লাহর বক্তব্যের পর আজ ঢাকায় দিল্লিতে 'জুলাই ঐক্য' নামের একটি ব্যানারে ভারতীয় হাইকমিশন ঘেরাওয়ের কর্মসূচির প্রেক্ষাপটে দিল্লিতে বাংলাদেশের হাই কমিশনারকে ডেকে পাঠায় দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এর আগে গত রোববার ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করেছিল।
সাবেক কূটনীতিক ও বিশ্লেষক হুমায়ুন কবির বলছেন, সেভেন সিস্টার্স নিয়ে কথা বলার কারণেই ভারতের দিক থেকে প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে, কারণ এটি তাদের জন্য নীতিগতভাবে একটি স্পর্শকাতর বিষয়।
"অনেকে হয়তো মিন করে অনেক কিছু বলেন না। কিন্তু এ ধরনের মন্তব্য অনেক সময় দু দেশের সম্পর্কে প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশ ও ভারতের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য," বিবিসি বাংলাকে বলেছেন মি. কবির।
এদিকে হাসনাত আব্দুল্লাহর বক্তব্য বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
বুধবার বিকেলে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে মি. হোসেন বলেন, "কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আমাদের ভূমিতে আশ্রয় দেবো, এই সরকার অবশ্যই সেটা করবে না। এবং আমি অনুমান করি যে বাংলাদেশের কোনো সরকারই করবে না। এটা একজন অ্যাক্টিভিস্ট-রাজনীতিক বলতে পারেন, তবে সরকারের অবস্থান অবশ্যই সেটা নয়।"

ছবির উৎস, facebook.com/hasnat.ab1
হাসনাত আব্দুল্লাহ যা বলেছিলেন, এনসিপি যা বলছে
বিবিসি বাংলার সর্বশেষ খবর ও বিশ্লেষণ এখন সরাসরি আপনার ফোনে।
ফলো করুন, নোটিফিকেশন অন রাখুন
বিবিসি বাংলার সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ বিবিসি বাংলার হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল
এবার মূলত ভারতবিরোধী প্রচার প্রচারণা নতুন গতি পেয়েছে ঢাকায় সম্প্রতি হত্যাচেষ্টার শিকার ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির ওপর সন্দেহভাজন হামলাকারী 'ভারতে পালিয়েছেন' এমন খবর সামাজিক মাধ্যমে চাউর হওয়ার পর।
মি. হাদি গত ১২ই ডিসেম্বর ঢাকার বিজয়নগরে নির্বাচনী প্রচার চালানোর সময় হামলাকারীরা একটি মোটরসাইকেলে এসে তাকে গুলি করে পালিয়ে যায়।
ঘটনার জন্য সন্দেহভাজন ব্যক্তি ভারতে পালিয়েছে এমন একটি খবর সামাজিক মাধ্যমে প্রচার শুরুর পর 'ভারত ইস্যু' নতুন করে আলোচনায় আসে এবং তারই ধারাবাহিকতায় সোমবার শহীদ মিনারে ইনকিলাব মঞ্চের উদ্যোগে 'সর্বদলীয় প্রতিবাদ সভায়' অনেকের কণ্ঠে ভারত ইস্যুটি উঠে আসে।
বাংলাদেশের পুলিশের পক্ষ থেকে সন্দেহভাজন ঐ ব্যক্তি ভারতে পালিয়েছে কিনা সেটি স্পষ্ট করা না হলেও এই মামলায় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে মানব পাচারের সাথে সংশ্লিষ্ট দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
সোমবার ইনকিলাব মঞ্চের আয়োজিত সভায়ই হাসনাত আব্দুল্লাহ তার বক্তৃতার এক পর্যায়ে বলেছেন, "নির্বাচন বানচাল করতে চাইছে, দেশের পরিবেশকে যারা অস্থিতিশীর করতে চাইছে, সীমান্তে যারা আমাদের ভাইদেরকে-বোনদেরকে মেরে ঝুলিয়ে রাখে, তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও পৃষ্টপোষকরা দিচ্ছে ভারত।"
"ভারতকে স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, যারা আমার দেশের সার্বভৌমত্বকে বিশ্বাস করে না, যারা আমার দেশের সম্ভাবনাকে বিশ্বাস করে না, যারা ভোটাধিকারকে- মানবাধিকারকে বিশ্বাস করে না, যারা এ দেশের সন্তানকে বিশ্বাস করে না, আপনারা (ভারত) যেহেতু তাদের আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন, কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই–– ভারতের যারা সেপারেটিস্ট আছে, বাংলাদেশে আমরা তাদের আশ্রয়-প্রশয় দিয়ে যে সেভেন সিস্টার্স আছে সেটাকে ভারতে থেকে আলাদা করে দেবো," বলেন তিনি।
ভারতকে শেখ হাসিনার 'পৃষ্ঠপোষক' উল্লেখ করে তিনি বলেন, "দিনের আলোর মতো স্পষ্ট-স্বচ্ছ, তাদেরকে ভারত অর্থ দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে, ট্রেনিং দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাদের দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।"
তিনি তার বক্তব্যে আরো বলেন, "আমাদের ভারতের বিরুদ্ধে একটি পার্শ্ববর্তী দেশ বলার কোনো সুযোগ নাই। আপনাদের জবানে স্পষ্ট করতে হবে, এই বাংলাদেশকে ভারত একটা ফিলিস্তিন বানাইতে চায়।"
"ক্ষমতার জন্য, ক্ষতির জন্য, মন্ত্রণালয়ের জন্য" যারা দিল্লির প্রতি আনুগত্য করছে তাদের বিরুদ্ধে ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি।
অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ওই সভাতেই তার বক্তৃতার এক পর্যায়ে বলেছেন, "ভারত থেকে আপনারা সন্ত্রাসের উসকানি দেবেন, সন্ত্রাস চালাবেন, আমার ভাইয়ের ওপর গুলি চালাবেন, এটা আমরা বরদাশত করব না"।

ছবির উৎস, facebook.com/hasnat.ab1
তবে এনসিপি বলছে, এটি মি. আব্দুল্লাহর 'নিজস্ব উপলব্ধি, দলীয় অবস্থান নয়"।
দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম রাজনৈতিক পরিষদ সদস্য এবং সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বিবিসি বাংলাকে পাঠানো দলের এক বিবৃতিতে বলেছেন, "এনসিপি বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্ব ও সীমানার প্রতি শ্রদ্ধাশীল"।
তবে ওই বিবৃতিতে বলা হয়, "কিন্তু ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে না। প্রধানমন্ত্রী মোদি আমাদের বিজয় দিবসকে অস্বীকার করেন। ভারত আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সীমান্তে আগ্রাসন চালায়, স্বাধীনতার পর শেখ মুজিব, জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে আগ্রাসন বিরোধী রাজনীতিবিদদের হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভারতের সংস্থা জড়িত ছিল, জুলাইয়ের নেতৃত্ব আগ্রাসন বিরোধী হওয়ায় হাদিসহ অন্যদেরও হত্যার ষড়যন্ত্রে ভারত সরাসরি জড়িত"।
এতে আরও বলা হয়, "হাসনাত আব্দুল্লাহ একটি সমাবেশে ভারতের সেভেন সিস্টার্স নিয়ে শর্তযুক্ত যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটি তার নিজের উপলব্ধি, এটি দলীয় অবস্থান নয়। তবে তার বক্তব্যের প্রেক্ষাপট রয়েছে। তিনি বলেছেন 'ভারত গণহত্যাকারী, সন্ত্রাসী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে আশ্রয় দিচ্ছে এই কাজ করলে বাংলাদেশও ভারতের দেখানো পথ অবলম্বন করবে', মানে বাংলাদেশ আগে করবে না, ভারত অলরেডি এসব কর্মকাণ্ড করছে। না থামালে বাংলাদেশ বাধ্য হবে"।

ছবির উৎস, Osman Hadi/facebook
দুই দেশের সম্পর্ক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে ভারত সরকারের সম্পর্ক শুরু থেকেই অনেক শীতল।
নভেম্বরের শুরুতে ভারতের 'নেটওয়ার্ক ১৮' গ্রুপের প্রধান সম্পাদক রাহুল যোশীকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে 'কথা বলার ক্ষেত্রে মনোযোগী হওয়ার' আহ্বান জানিয়েছিলেন।
জবাবে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মি. সিংয়ের ওই মন্তব্যকে 'অযথার্থ' এবং 'শিষ্টাচার ও কূটনৈতিক সৌজন্যের প্রতি সম্মানজনক নয়' বলে মন্তব্য করেছিল।
এবার হাসনাত আব্দুল্লাহর মন্তব্যের পর তা নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া এসেছে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার কাছ থেকে।
মঙ্গলবার স্থানীয় সাংবাদিকদের সামনে তিনি বলেন, "বাংলাদেশে গত এক বছরে এই চর্চা বার বার হচ্ছে যে নর্থ-ইস্টকে (ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল) ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশে যুক্ত করা উচিত, এটা বার বার আসছে। কিন্তু আপনারা জানেন ভারত একটি বড় দেশ, পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র এবং বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ কীভাবে এটা করবে? এটা তো ভাবাও ভুল।"
"কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের চিন্তাধারা খারাপ। তাদের অনেক বেশি সাহায্য করা আমাদের উচিত নয়। এবং এই লোকগুলোকেও এটা বুঝিয়ে দেওয়া উচিত যে ভারতের সঙ্গে এমন ব্যবহার করলে আমরা চুপ করে বসে থাকবো না," বলেন তিনি।
হিমন্ত শর্মা এর আগেও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ বিষয়ে কথা বলেছেন।

চলতি বছরের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস চীন সফরে গিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্য বা 'সেভেন সিস্টার্সকে' ল্যান্ডলকড উল্লেখ করে বলেছিলেন, তাদের সমুদ্রের ব্যবহারের ক্ষেত্রেই বাংলাদেশই একমাত্র অভিভাবক।
তখনো এর তীব্র সমালোচনা করেছিলেন হিমন্ত শর্মা। তিনি বলেছিলেন "যারা নিয়মিতভাবে ভারতের 'চিকেনস নেক' নিয়ে হুমকি দেয়, তাদের মনে রাখা উচিত—বাংলাদেশেরও দুটি এমন সংকীর্ণ করিডর রয়েছে, যা ভারতেরটির তুলনায় "অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ"। এক্স-এ দেওয়া এক পোস্টে তিনি লিখেছিলেন, "বাংলাদেশের দুটি নিজস্ব 'চিকেনস নেক' রয়েছে এবং দুটিই অত্যন্ত স্পর্শকাতর"।
পরে এ নিয়ে ভারতের তীব্র প্রতিক্রিয়ার পর এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলো প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর। কিন্তু এনসিপিসহ বিভিন্ন দলের নেতারা প্রকাশ্যেই ভারত ইস্যুতে নানা বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন।
কিন্তু এসব কিছুকে ছাপিয়ে এখন দুদেশের মধ্যে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে হাসনাত আব্দুল্লাহর বক্তব্য।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলছেন, রাজনীতিকদের এ ধরনের বক্তব্যের প্রভাব কখনো বেশ গভীর হয়, আবার কখনো হয় না।
"আমাদের বুঝতে হবে নীতিগতভাবে স্পর্শকাতর বিষয় কোনগুলো। সেভেন সিস্টার্স নিয়ে কথা বলাটা উদ্বেগের কারণ হয়েছে বলেই তাদের দিক থেকে প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে। কারণ এটি ভারতের জন্য স্পর্শকাতর। অনেকে হয়তো বক্তৃতায় কথার কথা অনেক কিছু বলেন। কিন্তু কিছু কথা থেকেই যায় এবং তা দু দেশের সম্পর্কেও প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশ ও ভারতের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।








