আপনি এই ওয়েবসাইটের একটি টেক্সট(লিখিত) সংস্করণ দেখছেন, যা কম ডেটা ব্যবহার করছে। ছবি ও ভিডিওসহ মূল সংস্করণ দেখতে এখানে ক্লিক করুন
বাংলাদেশ-বিরোধী বিক্ষোভকে ঘিরে দিনভর উত্তাল দিল্লি ও কলকাতা
- Author, শুভজ্যোতি ঘোষ
- Role, বিবিসি নিউজ বাংলা, দিল্লি
দিল্লির বাংলাদেশ হাই কমিশন অভিমুখে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর ডাকা বিক্ষোভ মিছিলকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার প্রায় সারাদিন উত্তাল হয়ে রইল ভারতের রাজধানী, বিশেষ করে শহরের কূটনৈতিক পাড়া চাণক্যপুরী।
বিক্ষোভকারীদের চাপে পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙল, 'বয়কট বাংলাদেশ' বা 'জাস্টিস ফর দীপু দাস' স্লোগান উঠল, মুহাম্মদ ইউনূসের কুশপুত্তলিকা পুড়ল – তবে শেষ পর্যন্ত তারা দূতাবাস ভবন পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি। প্রায় আধা কিলোমিটার দূরেই তাদের থামিয়ে দিয়েছিল দিল্লি পুলিশ।
বাংলাদেশে ময়মনসিংহের ভালুকায় দীপু চন্দ্র দাস নামে এক হিন্দু যুবকের হত্যার প্রতিবাদ এবং সামগ্রিকভাবে সে দেশে হিন্দু নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাতেই এদিনের এই বিক্ষোভের ডাক দিয়েছিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দলের মতো বিভিন্ন উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন।
গত শনিবার রাতেই একদল বিক্ষোভকারী একই ইস্যুতে প্রতিবাদ জানাতে দিল্লিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদুল্লাহ্-র বাসভবনের সামনে পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন। সেই প্রতিবাদ ছিল একেবারেই অঘোষিত ও আচম্বিত।
সে সময় নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে তারা খুব কাছাকাছি চলে যান এবং রাষ্ট্রদূতের প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত দেন বলে অভিযোগ উঠেছিল।
যদিও রোববার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রীতিমতো বিবৃতি দিয়ে সে অভিযোগ অস্বীকার করেছে, তবে বিষয়টি নিয়ে দুদেশের তিক্ত সম্পর্ক আরও তিক্ততার দিকে গেছে, উত্তেজনার পারদ চড়েছে।
তবে সে দিনের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েই হোক বা অন্য যে কোনো কারণে, এদিন বিক্ষোভকারীরা যাতে হাই কমিশন প্রাঙ্গণ অবধি পৌঁছতে না পারেন তার জন্য আজ দিল্লি পুলিশের সক্রিয়তা ছিল চোখে পড়ার মতো।
বেশ কয়েকটি ভাড়া করা বাসে এসে বেশ কয়েকশো বিক্ষোভকারী যখন দিল্লির রিং রোডের কাছে নেমে চাণক্যপুরীর বাংলাদেশ দূতাবাসের দিকে এগোচ্ছিলেন, তখন মোটামুটি পাঁচশো মিটার দূরে দুর্গাবাঈ দেশমুখ রোডের ট্র্যাফিক ক্রসিংয়ে তাদের রুখে দেয় দিল্লি পুলিশ। গোটা অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বাহিনীর ডেপুটি কমিশনার পদমর্যাদার একজন অফিসার।
তবে পুলিশের বাধাতেও বিক্ষোভকারীরা পিছু হঠতে রাজি না হওয়ায় সংঘাত বেশ তীব্র আকার ধারণ করে – লাঠিচার্জ চলতে থাকে, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্মীরা অনেকে পুলিশের দিকে পাল্টা তেড়ে যান, অনেকে রাস্তাতেই বসে পড়ে স্লোগান দিতে থাকেন। অনেকে মুহাম্মদ ইউনূসের কুশপুতুল জ্বালাতে থাকেন।
প্রায় ঘণ্টাদুয়েক ধরে এই অস্থিরতা চলার পর পুলিশ বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারীকে ধরে আটক করে নিয়ে গেলে বেলা বারোটারও পরে দিল্লির কূটনৈতিক পাড়ার পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়।
কলকাতায় বাংলাদেশ উপদূতাবাসের সামনে যা ঘটলো
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশন কার্যালয়ের সামনে হিন্দুত্ববাদী কয়েকটি সংগঠনের বিক্ষোভ ঘিরেও ছিল উত্তেজনা, সেখানে পুলিশকে লাঠিচার্জ পর্যন্ত করতে হয়েছে।
বাংলাদেশের ময়মনসিংহে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে দীপু চন্দ্র দাসকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা এবং তার মরদেহ জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনায় প্রতিবাদে সমাবেশ ডাকা হয়েছিল।
বিবিসি বাংলার সংবাদদাতা অমিতাভ ভট্টশালী ঘটনাস্থল থেকে জানান, মঙ্গলবার সকাল ১১টায় এই সমাবেশ শুরু হয়। কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশন কার্যালয়ের সামনে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বিচার দাবিতে স্লোগান দিচ্ছিলো।
নিরাপত্তার জন্য ডেপুটি হাই কমিশনের প্রায় দুশো মিটার দূর পর্যন্ত মোট তিনটি ব্যারিকেড দিয়েছিল পুলিশ। তবে সমাবেশ শুরুর কিছুক্ষণ পরই পুলিশের সাথে বিক্ষোভকারীরা ধাক্কাধাক্কি শুরু করে, এক পর্যায়ে প্রথম ব্যারিকেড ভেঙে ফেলে বিক্ষোভকারীরা।
এরপর দ্বিতীয় ব্যারিকেড পর্যন্ত তারা পৌঁছে যাওয়ার পর পুলিশ লাঠিচার্জ করে। দূতাবাসের অন্তত একশো মিটার দূরে বিক্ষোভকারীদের আটকে দেয় পুলিশ।
এই ঘটনার পর সন্ধ্যায় বাংলাদেশের উপদূতাবাসের দিকে মিছিল করেন বামপন্থি দলগুলোর নেতাকর্মীরা। দুপুরের মতোই এদের মিছিলও উপদূতাবসের দুশো মিটার আগেই থামিয়ে দেয় পুলিশ।
বামপন্থিরা অবশ্য ব্যারিকেড ভাঙার কোনো চেষ্টাও করেননি।
বামপন্থি নেতাদের বক্তৃতায় মূল সুর ছিল- তাদের ভাষায় "বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে"।
তারা বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপরে নির্যাতনের প্রসঙ্গের সঙ্গেই সংবাদমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর ওপরে হামলার বিরোধিতাও করেন প্রবলভাবে। তাদের কথায়, "ধর্মান্ধতার পাল্টা ধর্মান্ধতা হতে পারে না"।
সিপিআই (এম) এর রাজ্য সম্পাদক মুহাম্মদ সেলিম তাদের এই মিছিলের বিষয়ে বিবিসি বাংলাকে বলেন, "বাংলাদেশে যা হচ্ছে, সেকুলার ডেমোক্রেসিকে আক্রমণ করা হচ্ছে। যা কিছু মুক্ত চিন্তা প্রতীক, যা কিছু স্বাধীনতার প্রতীক এগুলো আক্রান্ত হচ্ছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে ধ্বংস করা হচ্ছে। আমরা তার প্রতিবাদ করছি।"
"সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়" এবং সেটা বাংলাদেশে ও ভারতে দুই জায়গাতে হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "আমরা এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছি"।
দিল্লিতে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা যে কারণে বিচলিত
গত কয়েকদিনের ঘটনাবলী দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের কূটনৈতিক পর্যায়ের ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের যে রীতিমতো উদ্বিগ্ন ও বিচলিত করে তুলেছে, তা বললে মোটেও ভুল বলা হবে না।
সেটার প্রধান কারণ, তারা মনে করছেন ইদানিং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের দূতাবাস ভবনের 'বিপজ্জনক রকম কাছাকাছি' আসতে দেওয়া হচ্ছে।
অথচ গত বছর দেড়েক ধরে দিল্লিতে বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভ কোনো নতুন ঘটনা নয়, কিন্তু এর আগে প্রতিবারই তাদের রাধাকৃষ্ণন মার্গের হাই কমিশন ভবন থেকে অনেক দূরেই রুখে দেওয়া হয়েছিল।
যেমন গত বছরের ডিসেম্বরেও (১০ই ডিসেম্বর) বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও সমমনা সংগঠনগুলো বাংলাদেশে কথিত হিন্দু নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ হাই কমিশনের সামনে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছিল, সে দিনের সমাবেশে প্রায় হাজার পাঁচেক জনতার বিপুল সমাবেশও হয়েছিল।
প্রতিবাদ মঞ্চে ছিলেন সাবেক কূটনীতিবিদ ভিনা সিক্রি, হিন্দুত্ববাদী নেত্রী সাধ্বী ঋতাম্ভরা বা বিজেপি এমপি, সাবেক বিচারপতি অভিজিত গাঙ্গুলির মতো হাই-প্রোফাইল বক্তারাও।
তবে সেদিন বিক্ষোভকারীদের কিন্তু বাংলাদেশ হাই কমিশনের ত্রিসীমানাতেও ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি, বরং তাদের রুখে দেওয়া হয়েছিল চাণক্যপুরী পুলিশ থানার সামনেই, যা দূতাবাস ভবন থেকে প্রায় দুই-আড়াই কিলোমিটার দূরেই!
এর তুলনায় গত শনিবার রাতের ঘটনার কোনো তুলনাই চলে না – যেখানে কয়েক ডজন বিক্ষোভকারী কার্যত বিনা বাধায় রাধাকৃষ্ণন মার্গে রাষ্ট্রদূতের বাসভবনের একেবারে সামনে রাস্তার ওপরে চলে আসে এবং তারপর টানা বেশ কয়েক মিনিট ধরে বাংলাদেশ বিরোধী স্লোগান দিয়ে ও গালিগালাজ করে চলে যায়।
দিল্লি পুলিশের সূত্রগুলো যদিও বলছে এই বিক্ষোভের কোনো আগাম খবর তাদের কাছে ছিল না এবং একেবারে আচমকাই জনাকয়েক বিক্ষোভকারী সেখানে চলে আসে – বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা কিন্তু এই দাবির সঙ্গে মিলছে না।
হাই কমিশনের একাধিক সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছেন, শনিবার সন্ধ্যা থেকেই তাদের কেউ কেউ দূতাবাস ভবনের অদূরে মধ্যপ্রদেশ সরকারের অতিথিশালার কাছে অজানা লোকদের জটলা লক্ষ্য করেছিলেন, যেটা চাণক্যপুরীর মতো হাই সিকিওরিটি এলাকায় একেবারেই অস্বাভাবিক একটা ঘটনা।
পরে এই জটলার ভিড় থেকেই অনেকে রাষ্ট্রদূতের বাসভবনের সামনে চলে এসেছিল বলে তাদের অনুমান।
সম্ভবত এই কারণেই পরদিন ঢাকায় বাংলাদেশে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনও মন্তব্য করেছিলেন, চাণক্যপুরীর অনেকটা ভেতরে অবস্থিত বাংলাদেশ হাই কমিশনের সামনেও যেভাবে বিক্ষোভকারীরা বিনা বাধায় ঢুকে পড়েছিল, তাতে তারা মনে করছেন "এদের আসতে অ্যালাও করা হয়েছে"!
প্রসঙ্গত, দিল্লিতে বাংলাদেশ হাই কমিশনের প্রশাসনিক ভবন ও রাষ্ট্রদূতের বাসভবন একই কমপ্লেক্সের ভেতর পাশাপাশি অবস্থিত – দুটোরই ঠিকানা রাধাকৃষ্ণন মার্গ।
গোটা ঘটনায় ভারত সরকারের অবস্থান কী?
বাংলাদেশ হাই কমিশনের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে রোববার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল যে বিবৃতি দিয়েছিলেন তাতেই এটা স্পষ্ট যে ময়মনসিংহে দীপু চন্দ্র দাসের হত্যার বিরুদ্ধে যাবতীয় প্রতিবাদকে ভারত সরকার 'যুক্তিসঙ্গত' বলে মনে করছে।
ভারত সরকারের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, যেরকম নৃশংসভাবে ওই হিন্দু যুবককে হত্যা করা হয়েছে তাতে সাধারণ ভারতীয়দের 'ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা'।
রোববার ভারতের বিবৃতির ভাষা ও ভঙ্গী থেকেও এটা বোঝা যায় যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাসভবনের সামনে যারা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, তাদের নিন্দা না করে প্রকারান্তরে ভারত তাদের একরকম 'ডিফেন্ড'-ই করেছে।
অথচ এ বছরের গোড়ার দিকে যখন আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাই কমিশনে নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে বিক্ষোভকারীদের ঢুকে পড়া বা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছিল ভারত কিন্তু সেই ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে দ্বিধা করেনি।
স্পষ্টতই ভারতের এখনকার মনোভাব তার তুলনায় একেবারেই আলাদা।
ভারতের কর্মকর্তারা একান্ত আলোচনায় বিবিসিকে বলেছেন, বাংলাদেশে ভারতবিরোধী বিক্ষোভ যেভাবে মাথাচাড়া দিচ্ছে, সে দেশের রাজনীতিবিদরা ভারতের বিরুদ্ধে ও সেভেন সিস্টার্স নিয়ে নানা ধরনের 'প্ররোচনামূলক' মন্তব্য করছেন এবং হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা ক্রমশ বেড়েই চলেছে বলে তারা দেখছেন – তাতে এখানেও এই ধরনের বাংলাদেশ-বিরোধী মনোভাব তৈরি হওয়াটা এক রকম অবধারিত।
গত অগাস্ট থেকেই ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে তীব্র টানাপোড়েন চলছে, সাম্প্রতিক এই ঘটনাপ্রবাহের জেরে তা একেবারে তলানিতে ঠেকেছে বলা যেতে পারে।