গানম্যান পেতে আবেদন করবেন যেভাবে, কারা পায়?

    • Author, সজল দাস
    • Role, বিবিসি নিউজ বাংলা

সম্প্রতি দুর্বৃত্তের গুলিতে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর পর নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক নেতা এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে নানা আলোচনা সামনে আসছে। একইসঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রে আছে 'গানম্যান' প্রসঙ্গ।

নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনায় রাজনৈতিক নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একটি তালিকা তৈরি করেছে সরকার। এছাড়া নিজের নিরাপত্তা চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদনও করেছেন অনেকে।

কেউ চেয়েছেন গানম্যান, আবার কারো চাহিদা ব্যক্তিগত অস্ত্রের লাইসেন্স। এসব আবেদনের প্রেক্ষিতে এখন পর্যন্ত অন্তত ২০ জনের জন্য গানম্যান নিযুক্ত করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

আরো কারা ঝুঁকিতে রয়েছেন সেই বিষয়টি পুলিশের বিশেষ শাখা যাচাইবাছাই করছে বলেও জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।

সাম্প্রতিক নানা ঘটনাক্রমে এমনিতেই নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে অনেকের মধ্যে। এমন প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক নেতা কিংবা বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য গানম্যান নিয়োগের আলোচনা, এর প্রক্রিয়া ও যথার্থতা নিয়ে কৌতূহল আরও বাড়িয়েছে।

গানম্যান নিয়োগ কিংবা ব্যক্তিগত অস্ত্রের লাইসেন্স, নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করবে কি না এমন প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ।

রাজনীতিবিদ, মানবাধিকারকর্মী এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, গানম্যান না দিয়ে বরং নির্বাচনের আগে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করা জরুরি।

অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, "নির্বাচনী প্রচারণার সময় আপনি কয়জনকে নিরাপত্তা দেবেন? আমেরিকার মতো জায়গায় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পর্যন্ত হিট করেছে। তার তো গানম্যান কম ছিল না।"

বিবিসি বাংলায় আরো পড়তে পারেন:

গানম্যান পেতে আবেদনের প্রক্রিয়া

বাংলাদেশে গানম্যান ও বডিগার্ড পাওয়ার বিষয়টি মূলত ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং রাষ্ট্রীয় প্রটোকল–– এই দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে।

এটি কোনো ঢালাও অধিকার নয়। বরং সরকারের বিশেষ বিবেচনায় অনুমোদিত একটি ব্যবস্থা।

তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চাইলে যে কাউকে তার বিশেষ ঝুঁকি বিবেচনা করে গানম্যান বরাদ্দ দিতে পারে।

অনেক সময় রাজনৈতিক ঝুঁকি বা গুরুত্বপূর্ণ মামলার সাক্ষী হওয়ার কারণেও সরকার নিজ উদ্যোগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গানম্যান দিয়ে থাকে।

পুলিশ সদরদপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলছেন, সাধারণ যে কেউ এ ধরনের নিরাপত্তা পেতে লিখিতভাবে পুলিশকে জানাতে হয়, অথবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হয়।

আবেদন প্রক্রিয়া শেষে গোয়েন্দা সংস্থা বা স্পেশাল ব্রাঞ্চ তদন্ত করে দেখে যে আবেদনকারীর সত্যিই নিরাপত্তা প্রয়োজন কি না, নাকি তিনি কেবল প্রভাব খাটানোর জন্য এটি চাচ্ছেন। প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত দীর্ঘ এবং কঠোর যাচাই-বাছাইয়ের বিষয়।

সাধারণত মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রোটেকশন বিভাগ অথবা স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে নিরাপত্তার জন্য গানম্যান বা বডিগার্ড নিয়োগ দেওয়া হয়।

"বডিগার্ড সাধারণত মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রটেকশন ইউনিট থেকে নিযুক্ত করা হয় এবং গানম্যান দেওয়া হয় স্পেশাল ব্রাঞ্চ বা বিশেষ শাখা থেকে," বলেন পুলিশের ওই কর্মকর্তা।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ বলছেন, সব ধরনের যাচাই প্রক্রিয়া শেষে পুলিশের প্রশিক্ষিত একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে যার জন্য নিরাপত্তা কর্মী দেওয়া হচ্ছে তার মতামতকেও প্রাধান্য দেওয়া হয়।

"অফিসিয়ালি সরকার নিয়োগ করলেও গানম্যান হিসেবে কাকে দেওয়া হবে এক্ষেত্রে যার নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত করা হচ্ছে তার মতামত নেওয়া হয়। কারণ এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের বিষয় থাকতে পারে," বলেন মি. আহাম্মেদ।

তিনি জানান, একজন গানম্যান সরকারি অস্ত্র ব্যবহার করেন এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক গুলিও তাদের জন্য বরাদ্দ করা থাকে।

এছাড়া গানম্যানের খরচ বহন করে সরকার, যেহেতু সরকার তাকে ওই কাজে নিয়োজিত করেছে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আনসার ভিডিপির সদস্যদের নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে নিয়োগের সুযোগ রয়েছে বলেও জানান মি. আহাম্মেদ।

কে এবং কেন গানম্যান পায়?

সরকারি প্রটোকল বা পদাধিকার ভিত্তিতে রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সরকারি গানম্যান বা সশস্ত্র দেহরক্ষী পান।

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, বিচারপতি, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা (সচিব বা সমপর্যায়ের) এবং বাহিনী প্রধানগণ এই ক্যাটাগরিতে পড়েন।

পুলিশের সাবেক প্রধান নুরুল হুদা বলছেন, একজন ব্যক্তি পুলিশের কাছে নানাভাবে নিরাপত্তা চাইতে পারেন। তবে, ব্যক্তি নিরাপত্তার জন্য গানম্যান বা বডিগার্ড নিয়োগের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়।

তিনি বলছেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে যাকে নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে তার আসলেই নিরাপত্তা প্রয়োজন কিনা সেটি যথার্থ হওয়া প্রয়োজন।

আদালতের কাছেও গানম্যান বা পুলিশি নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করা যায় বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছেন, কোনো সাধারণ নাগরিক বা প্রভাবশালী ব্যক্তি যদি মনে করেন তার জীবন বিপন্ন, তবে তিনি গানম্যানের জন্য আবেদন করতে পারেন।

"রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের, এই বিষয়টি সংবিধানেই উল্লেখ করা আছে। কিন্তু কোন ব্যক্তিকে নিরাপত্তা দিতে হবে সেটা সংবিধানের আলোকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এটি দেয়," বলেন তিনি।

এছাড়া নিজস্ব বেতনভুক্ত লোক দিয়েও গানম্যানের কাজ করান অনেকে। এক্ষেত্রে ওই গানম্যানের নিজের নামে অস্ত্রের লাইসেন্স থাকতে হবে অথবা নিয়োগকর্তার অস্ত্রের লাইসেন্সে তাকে 'রিটেইনার' বা ব্যবহারকারী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

এছাড়া সরকার অনুমোদিত বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানিগুলো থেকেও নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে গানম্যান নেওয়া যায়। তবে এক্ষেত্রেও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বিশেষ অনুমতি প্রয়োজন।

বাংলাদেশে অতীতেও নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে বিশেষ বিবেচনায় গানম্যান বা দেহরক্ষী নিয়োগ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

মুক্তমনা লেখক, প্রকাশক ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পাশাপাশি হুমকির ঘটনায় ২০১৪ সালেও অনেকের জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিয়েছিল সরকার।

পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ওই সময় ২৬২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির নিরাপত্তায় সাদা পোশাকে গানম্যান নিয়োগ করা হয়েছিল।

গ্যানম্যান নিয়ে বিতর্ক কেন?

দুর্বৃত্তের গুলিতে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর পর থেকেই আলোচনায় রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তার বিষয়টি।

সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনায় অন্তত ২০ জনকে সম্প্রতি গানম্যান দেওয়া হয়েছে। আরও অনেককে দেওয়া হতে পারে বলেও জানান তিনি।

মূলত তার এই বক্তব্যের পর থেকেই আলোচনায় রাজনৈতিক নেতাদের গানম্যান দেওয়ার প্রসঙ্গটি।

নিরাপত্তার জন্য গানম্যান চেয়ে সরকারের কাছে অনেক রাজনৈতিক নেতা যেমন আবেদন করেছেন, তেমনি সরকারও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে কয়েকজনের জন্য গানম্যান নিযুক্ত করেছেন।

সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। রাজনীতিবিদ, মানবাধিকারকর্মী এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক না হলে একজন গানম্যান দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

নিজের ওপর হামলার বিচার না হওয়ার পর্যন্ত সরকারের গানম্যান নেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর।

দলটির সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, "সরকার রাজনীতিবিদদের জন্য চিন্তা করেছেন এটা ইতিবাচক। তবে, নির্বাচনের আগে দেশের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নতি না হলে কোনো লাভ হবে না।"

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করা জরুরি বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ। তিনি বলছেন, কাউকে আঘাত করলে অপরাধীর বিচার হবে এই ভরসা মানুষকে দিতে না পারলে লাভ নেই।

"একটি ঘটনার পর অপরাধী যদি পার পেয়ে যায় তাহলে বাকি অপরাধীরাও উৎসাহিত হয়," বলেন তিনি।

নির্বাচনের আগে নির্দিষ্ট সংখ্যক ব্যক্তির জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা অযৌক্তিক নয়, তবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় কতজনকে এর আওতায় আনা হবে এটা বিবেচ্য বিষয় বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।

তিনি বলছেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর একজন সম্ভাব্য প্রার্থীর জন্য অস্ত্রের ব্যবহার নির্বাচনকে প্রভাবিতও করতে পারে, এটিও খেয়াল রাখা প্রয়োজন।

"আগের নির্বাচনগুলোতে আমরা দেখছি যে নির্বাচনের আগে সবার অস্ত্র ক্লোজ করা হতো। কারণ অস্ত্র থাকলে নিরাপত্তা যেমন নিশ্চিত হয় এটা ঠিক, অন্যদিকে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের বিষয়টিও থাকে," বলেন তিনি।