জামায়াত-এনসিপির ঐক্যে কার কতটা লাভ হলো

    • Author, রাকিব হাসনাত
    • Role, বিবিসি নিউজ বাংলা

বাংলাদেশে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামীর সাথে নির্বাচনী জোট বেধে নতুন করে আলোচনায় এসেছে ২০২৪ সালের অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি।

দলটির নেতারা এটিকে শুধুই 'নির্বাচনী সমঝোতা' হিসেবে আখ্যায়িত করলেও এ নিয়ে নানা ধরনের বিশ্লেষণ, আলোচনা, সমালোচনা হচ্ছে সামাজিক মাধ্যম ও সংবাদ মাধ্যমে।

জামায়াতের সাথে এ ধরনের জোট করা নিয়ে দলটির ভেতরকার ক্ষোভ ও অসন্তোষের জের ধরে ইতোমধ্যেই দল ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন দলটির বেশ কয়েকজন নেতা ।

যদিও কোন কোন বিষয়ে জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে সমঝোতা হয়েছে অর্থাৎ এনসিপির প্রার্থীরা কতটি আসনে নির্বাচন করবে এবং নির্বাচনের পরে কী হবে, জিতে সরকার গঠন করলে কী হবে আর বিরোধী দলের কী হবে—এসব বিষয়ে সুরাহা কতটা হয়েছে তা এখনো পরিষ্কার নয়।

তবে নির্বাচনী সমঝোতার মাধ্যমে কে লাভবান হলো – এনসিপি নাকি জামায়াত, এ প্রশ্নের চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে এনসিপির এ সিদ্ধান্ত দলটির ভবিষ্যতকে কোন দিকে নিয়ে যাবে সেই প্রশ্ন।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতির একজন নিয়মিত বিশ্লেষক ডঃ মোবাশ্বার হাসান বলছেন, এনসিপির ভবিষ্যৎ এই ভারত বিরোধিতার রাজনীতি কতদূর এগোয় তার ওপরই নির্ভর করবে। তবে নির্বাচনী সমঝোতা করা তাদের দু পক্ষের দিক থেকেই উইন উইন সিচুয়েশন বলে মনে করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামীম রেজা বলছেন, এনসিপিকে সাথে পেয়ে জামায়াতের কিছু সুবিধা হবে কারণ সংস্কার ও অন্য অনেক ইস্যুতে এনসিপিকে সাথে নিয়ে এগুনোর সুযোগ তৈরি হলো তাদের।

কিন্তু একে কেন্দ্র করে এত নেতা চলে যাওয়া বা নিষ্ক্রিয় থাকার ঘোষণা বা আপত্তি দেওয়ায় দলটির স্বতন্ত্র আদর্শের দল হিসেবে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাকে ক্ষীণ করে দিলো বলে মনে করেন তিনি।

বিবিসি বাংলায় আরও পড়ুন:

জামায়াত ও এনসিপি কী বলেছে

জামায়াতের সাথে নির্বাচনী জোটের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম রবিবারই এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড ও পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জাতীয় নাগরিক পার্টি জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা আট দলের সাথে নির্বাচনী সমঝোতায় সম্মত হয়েছে।

"এই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, আমরা দলীয় ফোরামে আলোচনা করেছি যে, এই মুহূর্তে এই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য, প্রতিযোগিতাপূর্ণ করার জন্য এবং যাতে আধিপত্যবাদী কোনো শক্তি আমাদের এই গণ অভ্যুত্থান পরবর্তী অগ্রযাত্রাকে ঠেকাতে না পারে সেজন্য আমাদের বৃহত্তর ঐক্য প্রয়োজন। সেই তাগিদ থেকেই আমরা জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের যে সমমনা আট দল রয়েছে তাদের সাথে আমরা কথা বলেছি " বলেছিলেন মি. ইসলাম।

আর নির্বাচনী জোটের ঘোষণা দেওয়ার সংবাদ সম্মেলন জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান এই জোটকে বর্ণনা করেছে 'দেশ গঠনের জোট, নির্বাচনের জোট ও রাজনৈতিক জোট' হিসবে।

তিনি বলেছেন, "এটা সকল ধরনের... মানে, ওই জোট বলেন আর সমঝোতা বলেন, যা-ই বলেন, এটা সবগুলো পারপাস কাভার করার জন্য। "

এনসিপি ও জামায়াতসহ মোট ১১টি দলের এই জোটে 'ন্যায্যতার ভিত্তিতে' আসন বণ্টন করা হবে বলে জানিয়েছেন মি. রহমান।

ফলে নির্বাচনে আসলে কোন দল কত আসনে নিজস্ব প্রার্থী দিবে তার জন্য মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

সমঝোতার আগেই সংকট, এনসিপিকে নিয়ে যত আলোচনা

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে যখন এনসিপি গঠিত হয় তখন মধ্যপন্থার বাংলাদেশের কথা বলেছিলো দলটি। কিন্তু শুরু থেকেই এর নেতৃত্বের একটি অংশকে 'জামায়াতের বি বা সি টিম' হিসেবে আখ্যায়িত করছিলেন অনেকে।

যদিও সাবেক তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, দলটির আহবায়ক নাহিদ ইসলামসহ কয়েকজন নেতা বিভিন্ন সময়ে জামায়াতকে ইঙ্গিত করে বা নাম উল্লেখ না করেও অনেক সমালোচনা করেছেন। মি. আলম অবশ্য এনসিপিতে যোগ দেননি এবং তিনি নির্বাচনও করছেন না।

এমন প্রেক্ষাপটে এককভাবেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছিলো দলটির কয়েকজন নেতার মুখে। আবার সম্প্রতি নির্বাচনের আলোচনার শুরুর দিকে বিএনপির সাথে নির্বাচনী ইস্যুতে একটা আলোচনা হচ্ছে- এমন খবরও এসেছিলো সংবাদমাধ্যমে।

কিন্তু ২০২৪ সালের শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের একজন আব্দুল কাদের ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জামায়াতের সাথে নির্বাচনে এনসিপি জোট করতে যাচ্ছে এমন খবর প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন ।

ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে তিনি নাহিদ ইসলামের বিরুদ্ধে 'মানুষের আবেগ নিয়ে প্রতারণার' অভিযোগ করেন।

তিনি ২৫শে ডিসেম্বর তার ফেসবুক পাতায় দেওয়া পোস্টে লিখেছেন, "তারুণ্যের রাজনীতির কবর রচিত হতে যাচ্ছে। এনসিপি অবশেষে জামাতের সাথেই সরাসরি জোট বাঁধতেছে। সারাদেশে মানুষের, নেতাকর্মীদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে জলাঞ্জলি দিয়ে গুটিকয়েক নেতার স্বার্থ হাসিল করতেই এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা"।

এরপর এনসিপির আরও অন্তত ৩০ জন নেতা দলটির আহবায়ক নাহিদ ইসলামের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জামায়াতের এনসিপিসহ মোট ১০ দলের জোটের পর দল থেকে যুগ্ম আহবায়ক তাজনূভা জাবীনসহ অন্তত চারজন নেতা পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন কয়েকজন।

দলটির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা তাসনিম জারাও দল থেকে পদত্যাগ করে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন ও সামান্তা শারমিনও।

আবার কেউ কেউ সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে দলীয় সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলেছেন, দলে থাকলেও তারা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সক্রিয় থাকবেন না।

দলের ভেতরে ও বাইরে সমালোচনার মুখে এনসিপির সাধারণ সম্পাদক আখতার হোসেন দলের ভেরিফায়েড পেজে শনিবার রাতে জানান, "সংস্কার ও রাষ্ট্র কাঠামো পুনর্গঠনের প্রশ্নেই জামায়াতসহ কয়েকটি দলের সঙ্গে এনসিপির মতের মিল তৈরি হয়েছে"।

কিন্তু লাভ কার হলো?

জামায়াতের সাথে নির্বাচনী সমঝোতায় পৌঁছানোর ঘোষণার পর সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই অভিযোগ করছেন যে, এনসিপির যে অংশটি জামায়াতের সাথে সমঝোতায় গেছে তারা 'জামায়াতপন্থী' বলেই নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতের দিকে ঝুঁকেছেন।

আবার কেউ বলছেন, আলোচনা বা দরকষাকষিতে জামায়াতের কাছ থেকেই বেশি সুবিধার নিশ্চয়তা পেয়েছে এনসিপি, যে কারণে তাদের সাথে নির্বাচনী সমঝোতায় পৌঁছেছে দলের শীর্ষমহল।

যদিও কিসের ভিত্তিতে সমঝোতা হয়েছে বা নির্বাচনে কারা কিভাবে অংশ নিবেন কিংবা নির্বাচনের পরে কী হবে তার বিস্তারিত এখনো কোনো পক্ষ প্রকাশ করেনি। প্রাথমিকভাবে বলা হয়েছে, এনসিপির আসনে জামায়াত তার প্রার্থী দেবে না বা সরিয়ে নেবে।

একই ভাবে এনসিপি জামায়াত ও সমমনা অন্য দলগুলোর প্রার্থী যেখানে থাকবে সেখানে কোনো প্রার্থী না দিয়ে জোটের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবে। এছাড়া সংস্কার ও আধিপত্যবাদবিরোধী অবস্থান থেকেও দুই দল একসাথে কাজ করবে।

প্রসঙ্গত, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই এনসিপির কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ভারত বিরোধী বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় এসেছেন।

বাংলাদেশের রাজনীতির একজন বিশ্লেষক ডঃ মোবাশ্বার হাসান বলছেন, আপাতদৃষ্টিতে দুই দলের জন্যই উইন-উইন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, কারণ এককভাবে নির্বাচন করার মতো লোকবল এনসিপির নেই এবং সে কারণেই তারা জামায়াতের পার্টি মেশিনারিজের সুবিধা নিশ্চিত করতে চেয়েছে।

"আবার জামায়াতের ইমেজ সংকট আছে দেশের জনগণের একটি অংশের কাছে। সেটাকে জামায়াত নরমালাইজ করার চেষ্টা করছে। মুক্তিযোদ্ধা অলি আহমদকে টেনেছে। এনসিপিকেও তারা একই কারণে সাথে নিয়েছে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

মি. হাসান বলছেন, দেশে ভারতবিরোধী আবহ জোরদার হওয়াটাকে এনসিপি-জামায়াত ঐক্যের একটি কারণ বলে তিনিও মনে করেন।

তার মতে, এনসিপি জামায়াতসহ যাদের সাথে সমঝোতায় গেছে তাদের লক্ষ্য হবে ভারত বিরোধিতাকে এগিয়ে নিয়ে গণজোয়ার তৈরির মাধ্যমে নির্বাচনী সুবিধা অর্জন করা।

"সেটা সফল হবে কি-না তা সময় বলে দিবে। আবার গণ অভ্যুত্থানের মুখ হিসেবে নাহিদের ভিন্ন অবস্থান আছে। কিন্তু এখন দল হিসেবে তাদের ভবিষ্যৎ কেমন হবে বা ধূসর হয়ে যাবে কি-না তা নির্ভর করবে তারা জামায়াতকে নিয়ে এন্টি ভারত জোট হিসেবে সামনে এগিয়ে নেওয়ার যে চেষ্টা করছে সেটা কতটা সফল হয় তার ওপর," বলছিলেন তিনি।

অধ্যাপক শামীম রেজা অবশ্য মনে করেন এনসিপিকে জোটে টেনে জামায়াতই কিছুটা লাভবান হলো কারণ এনসিপির ভাবমূর্তি জামায়াত ঘরানার বাইরের ভোট টানতে সহায়ক হবে।

"আবার এনসিপি নেতাদের প্রকাশ্য ও সামাজিক মাধ্যমে সরব উপস্থিতির কারণে সমালোচনা শুনতে হয় এমন ইস্যুতে এনসিপিকে কাছে পাওয়ায় সুযোগ তৈরি হয়েছে জামায়াতের। যদিও জামায়াতের সাথে জোটবদ্ধ হওয়াতে এনসিপি কিছুটা প্রশ্নের মুখে পড়েছে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

তবে তার মতে, অল্প সময়ের মধ্যে গঠিত হওয়া এনসিপির কিছু নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ও বিভিন্ন বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার ধাক্কার পর এখন আবার কিছু নেতার দলত্যাগের ঘটনা দলটিকে সামনের দিনগুলোতে নতুন চ্যালেঞ্জে ফেলার সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

"জাতীয় নির্বাচন বা গণভোটের আগে এতো নেতার চলে যাওয়া বা নিষ্ক্রিয় হওয়া তাদের জন্য খুবই হতাশার। এটি দলটির বিকাশের সম্ভাবনাকে সংকুচিত করেছে," বলছিলেন মি. রেজা।