‘আমাকে সৌদি আরব ছাড়তে হয়েছিল যে কারণে’

অনেক বছর বিদেশে কাটানোর পর স্থায়ী বসবাসের উদ্দেশ্য নিয়ে ২৯ বছর বয়সী বাসমা খালিফা ফিরেছিলেন মাতৃভূমি সৌদি আরবে। বিবিসিকে তিনি বলছিলেন, কিভাবে তাকে ছোট একটি ভুলের মাশুল দিতে হলো, যার কারণে তাকে আবার সৌদি আরব ছাড়তে হয়।

২০১৮ সালের অক্টোবরে আমাকে সৌদি আরব ছাড়তে বলা হয়েছিল। যে মাটিতে আমি জন্মেছি, যেখানে আমি ভেবেছি নতুন করে হয়তো জীবন শুরু করতে পারবো।

আমি সৌদি আরবে স্থায়ী বসবাসের প্রস্তুতি হিসেবে সেসময় বিবিসির জন্য এক ডকুমেন্টারির শুটিং করছিলাম।

কয়েকজনের মুখে শুনেছিলাম সেখানে একটি পত্রিকায় খবর ছাপা হয়েছে বেশ কয়েকজন নারী আন্দোলন কর্মীদের আটক করে জেলে পোরা হয়েছে।

আমাকে তড়িঘড়ি দেশ ছাড়তে বলা হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল আমার আচরণের মাধ্যমে আমি 'দেশের সমালোচনা' করেছি।

ঐ মুহূর্তে আমার একমাত্র যে অনুভূতি হয়েছিল, সেটা ছিল একটা প্রবল ধাক্কা।

আরো পড়ুন:

কারণ মেয়েদের গাড়ি চালানোর অধিকার দাবী করে কারাবরণ করা নারীদের নিয়ে লেখা ঐ প্রতিবেদনটি পড়া ছাড়া ততক্ষণ পর্যন্ত আমি সেটা নিয়ে আর কিছুই করিনি।

এরপরই আমাকে তীব্র একটা ভয় ঘিরে ধরেছিল।

এরপরে আমার নিজের ওপরই সন্দেহ হতে শুরু করলো আমি হয়তো বেখেয়ালেই কোন ভয়ানক অন্যায় করে ফেলেছি। সবকিছু এত তাড়াতাড়ি ঘটছিল, আমি ঠিকঠাক ভাবতেও পারছিলাম না কোন কিছু।

আমি যদি দুঃসাহস করে থেকে যাই, তারা হয়তো আমার ভিসা বাতিল করে দেবে। আমি লন্ডন ফিরে যাবার জন্য ফ্লাইট বুকিং দেই, আর সেদিনই ফিরে যাই।

আমি সর্বশেষ ২৫ বছর আগে সৌদি আরবে ছিলাম, তখন আমার বয়স খুবই কম। এরপর যখন আমি ফিরে আসলাম, এদেশের তখন অনেক অগ্রগতি হয়েছে।

বিবিসি বাংলার অন্যান্য খবর:

সমুদ্র সৈকত, শপিং মল আর অভিজাত সব খাবার দোকান---এসব কিচ্ছু ছিল না আমাদের ছোটবেলায়। আমি ছয়দিন ছিলাম ঐ দেশে, প্রতিটা দিন বৃষ্টি হয়েছিল।

সবাই ঠাট্টা করতো যে আমি সাথে করে লন্ডনের বৃষ্টি নিয়ে এসেছি।

আমার জন্ম ১৯৮৯ সালে, আমার বাবা-মা ছিলেন সুদানীজ।

তারা মিসরের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে পরস্পরের প্রেমে পড়েছিলেন। আমার বাবা ছিলেন ডাক্তার, বিয়ে করে আমার মা'কে নিয়ে সৌদি আরবে চলে আসেন।

এরপর কয়েক বছর পরে তিনি উত্তর আয়ারল্যান্ডে চলে আসেন, আমার বয়স ছিল তখন তিন বছর।

আমার ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত আমরা উত্তর আয়ারল্যান্ডে ছিলাম।

এরপর স্কটল্যান্ডে চলে যায় আমার পরিবার, ২০ বছর বয়স পর্যন্ত সেখানে ছিলাম আমরা।

এরপর ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে পড়াশোনার জন্য আমি ছয়মাস নিউ ইয়র্কে ছিলাম, এরপর লন্ডনে এসে ফ্যাশন নিয়ে কাজ করতে শুরু করি।

আমি ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে বিভিন্ন দেশের নারীদের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি কাজ করছিলাম।

কিছুটা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার মত করে। আর ধরুন আমি যেন নিজেকেই প্রশ্ন করে ক্রমে জানার চেষ্টা করছিলাম আমার আসল ঠিকানা আসলে কোথায়!

মানে আমি জন্মেছি যে দেশে, সেটা আমার দেশ নয়, এরপর বড় হয়েছি যেসব দেশে সেগুলোও আমার দেশ নয়।

শৈশব কৈশোরের বড় অংশটি কেটেছে মধ্যপ্রাচ্যে আর বড় হওয়া আর কাজকর্ম সব পশ্চিমে—ফলে আমি যেন নিজের ঠিকানা সম্পর্কে ঠিক নিশ্চিত ছিলাম না।

মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে বৈপ্লবিক বা ঝুঁকিপূর্ণ কিছু করার ইচ্ছা আমার ছিল না, আমি কেবল দেখতে চেয়েছিলাম প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য দুই অভিজ্ঞতা আছে এমন একজন অল্প বয়সী নারী সৌদি সমাজে টিকে থাকতে পারে কিনা।

কিন্তু শুরুতেই কর্তৃপক্ষ আমার সঙ্গে একজন কর্মকর্তা দিয়ে দিলো, যার কাজ আমি নিয়ম কানুন মেনে চলছি কিনা সেই খোঁজ রাখা।

আমি জানতাম এখানে মেয়েদের খুবই সীমিত পরিসরে চলতে হয়।

আর অক্টোবরে যুক্তরাজ্য ছেড়ে এ দেশে আসার পর, বিরোধীদের কিভাবে দেখে কর্তৃপক্ষ, সে ধারণাও আমি পেয়েছি।

ঐ মাসের দুই তারিখেই সাংবাদিক জামাল খাসোগজির নিখোঁজ হবার পরে তাকে হত্যার খবর পাওয়া যায়।

আমি তারপরেও ভয় পাইনি। আমার খালারা সেখানে থাকেন, তারাও আমাকে নিয়মকানুনের ব্যাপারে সতর্ক করে দিচ্ছিলেন।

আমাদের বোরকা পড়ে কাজ করতে বলা হয়েছিল, আমরা সে অনুযায়ী বোরকা পড়েই কাজ শুরু করি।

একদিন আমার কাজ তদারকির জন্য যে সরকারি কর্মকর্তাকে দেয়া তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে আমি গাড়ি চালাতে পারি কিনা।

আমার যুক্তরাজ্যে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স আছে।

তখন তিনি অন্য গাড়িটি থেকে আমার মোবাইল ফোনটি সংযুক্ত করে দিলেন একটি কেবলের মাধ্যমে।

আমি তখন জোরে জোরে সেই আর্টিকেলটি পড়া শুরু করলাম যেটাতে মেয়েদের গাড়ি চালানোর দাবীর কারণে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

কিন্তু সেটা করা হয়েছিল যখন দেশটিতে মেয়েদের গাড়ি চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছি।

কিন্তু ততক্ষণে কর্তৃপক্ষ যুক্তরাজ্যে আমার বসকে বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছেন। এবং তাদের বলা হয়েছে, আমি কত বড় অপরাধ করেছি।

যুক্তরাজ্যে আমার বস যিনি ছিলেন, তিনি আমাকে তৎক্ষণাৎ দেশে ফিরে আসতে।

তবে, আমি ভাবি নাই যে আমি সেজন্য গ্রেপ্তার হতে পারি।

কারণ আমি কেবল একটি আর্টিকেল পড়েছি।

যাই হোক পরিস্থিতি দ্রুতই বদলে যেতে থাকে, এবং শেষ পর্যন্ত খুব দ্রুত আমাকে সৌদি আরব ছাড়তে হয়।