উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-আনের অনুকরণকারীদের বিচিত্র জীবন: দিনে রোজগার ১০ হাজার ডলারেরও বেশি

হাওয়ার্ড এক্স রাজনীতির একজন সমালোচক। থাকেন হং কং-এ। আরেকজন আছেন মিনিয়ং কিম, যার আরেকটি নাম ড্রাগন কিম, থাকেন দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সউলে।

তাদের দু'জনের মধ্যে একটা মিল আছে। বড় রকমের মিল। আর সেটা হলো তারা দুজনেই দেখতে অনেকটাই উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-আনের মতো।

এই জিনিসটাকে কাজে লাগিয়েই তারা গড়ে তুলেছেন নিজেদের এমন কিছু পেশা যা থেকে তারা প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজার ডলারের বেশি আয় করছেন।

এসব পেশার মধ্যে রয়েছে ভিডিও গেমের জন্যে অভিনয় করা, শপিং মলের উদ্বোধন এবং ধনকুবেরদের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আগাত অতিথিদের মনোরঞ্জন করা। এই কাজগুলোই তারা করে আসছেন গত প্রায় ছয় বছর ধরে।

"কিম জং-আন ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার কথা ঘোষণা করেন, কিম্বা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে 'বুড়ো হাবড়া' বলে ডাকেন তখনই আমার ফোনে কল আসে আর আমি একটা কাজ পেয়ে যাই," বলেন হাওয়ার্ড। "সবসময় একেবারে শেষ মুহূর্তে কাজটা আসে। মাত্র ২৪ ঘণ্টার নোটিসে। এবং এটা যেকোন কিছুই হতে পারে।"

মিনিয়ং-এর এখন আলোচনা চলছে কেন্টাকি ফ্রাইড চিকেন ফাস্টফুড কোম্পানির সাথে। তাদের নতুন একটি বিজ্ঞাপনে অভিনয় করা নিয়ে।

অন্যদিকে হাওয়ার্ড গিয়েছিলেন ম্যাকাওতে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে, যেখানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও প্রেসিডেন্ট পুতিনের মতো দেখতে আরো দুজন উপস্থিত ছিলেন।

"বড় একটি মিসাইলের মতো দেখতে একটি কেক বানানো হয়েছিল ওই অনুষ্ঠানের জন্যে। আমাদের তিনজনে মিলে ওই কেকটিকে কাটতে হয়েছে," বলেন তিনি।

কিম জং-আন যখন ক্ষমতায় আসেন ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে, মিনিয়ং তখনও দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক বাহিনীতে চাকরি করতেন।

"সেসময় খুব চাপ তৈরি হতো। কিম জং-আন যখনই কিছু করতেন বা বলতেন, আমার ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন যারা ছিলেন তারা আমার কাছে এসে বলতেন, এটা তোমার কারণে হচ্ছে, কারণ তুমি দেখতে তার মতো।"

সামরিক বাহিনীর চাকরি শেষে তিনি এই জিনিসটাকেই তার রোজগারের জন্যে কাজে লাগাতে চাইলেন। একদিন তিনি তার পাড়ার নাপিতকে বললেন, কিম জং-আনের মতো করে তার চুল কেটে দিতে। তারপর মি. কিমের কোটের মতো একটা কোট কিনলেন সস্তায়।

তারপর চলে গেলেন সউলের একটা রাস্তায়। লোকজন তখন তাকে ঘিরে ধরলো।

"হাজার হাজার মানুষ আমার ছবি তুলতে শুরু করলো। পরদিন আমি দেখলাম সব টিভিতে আমাকে দেখানো হচ্ছে। এক মাসের মধ্যেই দেখলাম বিভিন্ন কোম্পানি থেকে তাদের বিজ্ঞাপনে অভিনয় করার জন্যে আমাকে অনুরোধ করা হচ্ছে।"

প্রায়ই একই রকমভাবে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান হাওয়ার্ডও। আর এটা শুরু হয় কোন এক 'এপ্রিল ফুল' দিবসে ফেসবুকে কিম নাম দিয়ে তার একটি ছবি পোস্ট করার মধ্য দিয়ে।

সেসময় ওই ছবিটি ভাইরাল হয়ে যায়। কিন্তু মি. কিমের মতো করে চুল কাটতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে যান তিনি।

"তার মাথার পেছন দিকে চুল কেমন তার তো কোন ছবি ছিল না। সেটা যোগাড় করাও কঠিন। তখন এ নিয়ে আমি কিছু গবেষণা করি। তার বহু ছবি প্রিন্ট করি। সেগুলোকে আমি একজনের কাছে নিয়ে যাই। তিনি তখন সবকিছু ঠিক করে দেন। তারপর থেকে তিনিই আমার স্টাইল ঠিক করে দেন।"

আরো পড়তে পারেন:

মিনিয়ং শৈশবে স্বপ্ন দেখতেন একজন অভিনেতা হওয়ার। কিন্তু পরে তিনি অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু শেষমেশ কিম জং-আনের নক করাকেই তিনি তার পেশা করে নিলেন।

এজন্যে তিনি রপ্ত করে নিলেন কিম জং-আন কীভাবে কথা বলেন, তার উচ্চারণ, গলার স্বর- যাতে যতোটা সম্ভব তাকে উত্তর কোরিয়ার নেতার মতোই মনে হয়।

হাওয়ার্ড বড় হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। কোরিয়ান ভাষাও তিনি জানেন না।

কিন্তু একটি চিলি ক্র্যাব রেস্তোরার উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছেন, "কে সবচেয়ে বেশি সুন্দর স্বৈরাচার, আমি নাকি তোমাদের প্রধানমন্ত্রী?"

রাশিয়ার একটি ব্যান্ডের তৈরি মিউজিক ভিডিওতে তিনি অভিনয় করেছেন। যেখানে দেখা যাচ্ছে একটি মিসাইলের প্রেমে পড়ার পর তিনি ওই একটি পারমাণবিক বোমাকে নিয়ে বিছানায় গেছেন।

শুধু উত্তর কোরিয়া নয়, দক্ষিণ কোরিয়ার কিছু স্বেচ্ছাসেবী যারা উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা লোকজনকে সহযোগিতা করছেন তারাও মিনিয়ং-এর কড়া সমালোচক।

এসব করতে গিয়ে তাদেরকে নানা রকমের ঝুঁকির মধ্যেও পড়তে হচ্ছে।

নিউ ইয়র্কে সফরে যাওয়ার পর এক ব্যক্তি মিনিয়ং-এর মুখের ওপর ঘুষি বসিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ তিনি মনে করেছিলেন যে আসলেই তিনি উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-আন।

কিন্তু তখন তাকে তারই এক বন্ধু ওই হামলার হাত থেকে তাকে রক্ষা করেন। তিনিও মিনিয়ং-এর সাথে মি. কিমের দেহরক্ষী সেজে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন।

শুধু তাই নয়, তার জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ার কারণে উত্তর কোরিয়ার গোয়েন্দারাও এখন তার ওপর কড়া নজর রাখতে শুরু করেছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

"একদিন আমি দেখলাম যে আমার ব্যক্তিগত ইমেইল অ্যাকাউন্টটি হ্যাক হয়ে গেছে। আমার পাসওয়ার্ডটি খুবই জটিল এবং আমি সেটা কখনও বদলাই নি। আমি দেখলাম শেষবারের মতো কোথায় লগ করা হয়েছিল। তখন দেখি এটি করা হয়েছে চীনের কোন একটি এলাকা থেকে। আমি তখন জাতীয় গোয়েন্দাদেরকে বিষয়টি জানাই। তারা আমাকে বলেছেন এটা উত্তর কোরিয়ার গুপ্তচরদের কাজ," বলেন তিনি।

তিনি বলেন, তার পরিবার ও বন্ধুদের অনুরোধে তিনি এসব ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন।

দক্ষিণ কোরিয়ার টেলিভিশনে ২০১৪ সালে বলা হলো যে উত্তর কোরিয়া সতর্ক করে দিয়েছে কেউ যদি কিম জং-আনকে নকল করে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে।

তখন তিনি রাজনৈতিক বিষয়ে কথাবার্তা বলা বন্ধ করে দিলেন। কারণ তিনি মনে করেছিলেন এরকম করলে তাকে অপহরণ করা হতে পারে। এমনকি তাকে হত্যাও করা হতে পারে।

কিন্তু হাওয়ার্ড এসবের ভয়ে ভীত নন মোটেও। তিনি বলেছেন, উত্তর কোরিয়া তার কিছুই করতে পারবে না।

হাওয়ার্ড বলেন, মিনিয়ং অনেক সময় সস্তায় কাজ করতে রাজি হয়ে যান। এর ফলে তার রোজগার কমে যাওয়ারও একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, মিনিয়ং কখনো কখনো পয়সা ছাড়াই কাজ করতে রাজি হয়ে যান। যেমন কখনো কখনো তিনি কিম জং-আনের রাতের পোশাক পরেই সউলের রাস্তায় বের হয়ে পড়েন।

মিনিয়ং বলেন, কিম জং-আনকে অনুসরণ করে তিনি যেসব করেন সেটা তার বান্ধবীর পছন্দ নয়। "তার হেয়ার-স্টাইল ওর খুবই অপছন্দের।"

"সে আমার এসব পছন্দ করে কারণ যখন আমি কোন পানশালায় যাই মেয়েরা আমার সাথে ছবি তুলতে চায়। তারা আমাকে জড়িয়ে ধরতে, চুমু দিতে চেষ্টা করে। এরকম হওয়ার আগেই আমাদের প্রেম শুরু হয়েছিল। এখন সে বলে ও যদি জানতো আমি এরকম কাজ করবো তাহলে সে নাকি আমার সাথে প্রেমই করতো না। সেকারণে আমি এসব কমিয়ে ফেলার চেষ্টা করছি।"

"ট্রাম্পের মতো দেখতে যে আমি তাকে বলেছি, তুমি এখনও কিছু পয়সা বানিয়ে নাও। কারণ তোমার তো চার কিম্বা আট বছরের সময়। কিন্তু আমি যে স্বৈরাচারকে অনুকরণ করছি সেটা তো আজীবনের," বলেন হাওয়ার্ড।